ডালিমের উপকারিতা: সুস্থতার প্রতিশ্রুতি

(ডালিমের স্বাস্থ্য উপকারিতা)

ডালিম ছোট বড় সবারই পছন্দের একটি ফল। দেখতেও খুব সুন্দর। তাই, চোখের সঙ্গে মনও কাঁড়ে সবার। আবার, ডালিমকে স্বর্গীয় ফলও বলা হয়। কারণ এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জাদুকরী ক্ষমতা। এটার বৈজ্ঞানিক নাম “Punica granatum”।

ডালিম বা বেদানার মধ্যে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী গুনাগুণ থাকা শর্তেও, কিছুটা দামি হওয়ার কারণে অনেকেই ডালিম খেতে চান না। নিয়মিত ডালিম খেলে দেহের বহু উপকার পাওয়া যায়। ডালিম ফল, ডালিম গাছের পাতা, ছাল, মূল, মূলের ছাল সবই ওষুধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

তাই আজ আমরা ডালিমের স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব-

ডালিমের স্বাস্থ্য উপকারিতা

ডালিমের স্বাস্থ্য উপকারিতা

1.ডালিমের ঔষধি গুনাগুন

ডালিম ফল আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসায় পৈথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডালিমে বিউটেলিক এসিড, আরসোলিক এসিড এবং কিছু আ্যলকালীয় দ্রব্য যেমন- সিডোপেরেটাইরিন, পেপরেটাইরিন, আইসোপেরেটাইরিন, মিথাইলপেরেটাইরিন প্রভৃতি মূল উপাদান থাকায় ইহা বিভিন্ন রোগ উপশমে ব্যবহৃত হয়।

কবিরাজী মতে ডালিম হচ্ছে হৃদয়ের শ্রেষ্ঠতম হিতকর ফল। এ ফল কোষ্ঠ রোগীদের জন্য উপকারী বলে মনে করা হয়। গাছের শিকড়, ছাল ও ফলের খোসা দিয়ে আমাশয় ও উদরাময় রোগের ওষুধ তৈরি হয়। এটা ত্রিদোষ বিকারের উপশামক, শুক্রবর্ধক, দাহ-জ্বর পিপাসা নাশক, মেধা ও বলকারক, অরুচিনাশক ও তৃপ্তিদায়ক। ডালিমের ফুল রক্তস্রাবনাশক হিসেবেও কাজ করে।

2.রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে

ডালিমের রসে পিউনিসিক নামক এক ধরনের অ্যাসিড রয়েছে যেটা কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।

পাশাপাশি, ডালিম রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া ডালিমে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকার কারণে ‘ফ্রি রেডিক্যাল’, কোলেস্টেরল এবং রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে। ডালিমের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রক্তের ঘনত্ব ঠিক রাখে এবং এর বীজ রক্তের প্লাটিলেট জমাট বাঁধতে ও ঘন হতে বাধা দেয়।

এছাড়াও ডালিমের মধ্যে বিভিন্ন রকমের খনিজ উপাদান রয়েছে। যেমন: আয়রন,ক্যালসিয়াম ও ফাইবার যেগুলো দেহে রক্ত সঞ্চালন সচল রাখতে সাহায্য করে। ডালিম রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়াতেও সাহায্য করে।

3.হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে

ডালিম দেহের কোলস্টেরলের ঝুঁকি কমায়। এতে রক্তচলাচল বৃদ্ধি পায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়।এছাড়া, ডালিম মাংস পেশিতে দ্রুত অক্সিজেন পৌঁছে দিতে সাহায্য করে। আবার, ডালিমের রস দেহের ক্ষতিকর চর্বির স্তরকে গলিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। যেটা হার্টের জন্য খুবই ভালো।

এছাড়াও ডালিমে উপস্থিত থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। যেটা রক্তের মধ্যে মোনোসাইট কেমোট্যাকটিক প্রোটিন কমিয়ে ফেলে। ফলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। তাই হৃদরোগের হাজারো সমস্যার সমাধান পেতে প্রতিদিন একটি করে ডালিমের রস খেতে পারেন।

4.স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে

স্মৃতি বলতে মূলত তথ্য ধারণ করে পুনরায় তা ফিরে পাওয়ার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, মস্তিষ্কে তথ্য ধারণ করে রাখার প্রক্রিয়া কিংবা মস্তিষ্কে ধারণকৃত তথ্যকে স্মৃতি বলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে তথ্য আহরণ করে মস্তিষ্কে জমা করা হয় এবং সেটা পরে দরকার অনুযায়ী সেখান থেকে খুঁজে বাহির করা হয়। জমাকৃত এই তথ্য হারিয়ে গেলে কিংবা সময়মত খুঁজে পাওয়া না গেলে তা দূর্বল স্মৃতিশক্তির লক্ষণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। আর এই স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে ডালিমের ভূমিকা অনেক।

স্মৃতিশক্তি কম এমন কিছু ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষার জন্য, তাদেরকে প্রতিদিন ২৩৭ মি.লি ডালিমের রস খাওয়ানো হতো। নির্দিষ্ট সময় পর পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, তাদের প্রত্যেকেরই স্মৃতিশক্তির উন্নতি হয়েছে। আর এ কারণে এটি অ্যালঝেইমার্সের মতো রোগীদের জন্যও উপকারি।

5.ডালিমকে বলা হয় প্রকৃতির ইনসুলিন

ডালিম ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুব উপকারী একটি ফল। এটি মিষ্টি হলেও সাধারণত ডায়াবেটিস রোগীদের কোনো সমস্যা হয় না। ডালিমের রসে ফ্রুক্টোজ থাকলেও এটি অন্য ফলের মতো রক্তে চিনির মাত্রা বাড়ায় না।

অন্যদিকে, ডালিমে প্রচুর পরিমাণে উপস্থিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা টক্সিন দূর করে ডিটক্সিফিকেশনে সাহায্য করে। কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রনে ডালিমের রসে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এল ডি, যা হার্টের মাসলসে অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখে। পাশাপাশি, ফ্রিরেডিকেল প্রতিরোধ করে খারাপ কোলেস্টরেল বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। তাই, রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হলে রোজ ডালিমের রস খেতে পারেন।

6.ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে ডালিমের উপকারিতা

বর্তমানে বহু পুরুষই প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত। বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে বেদানার রস ক্যান্সারের কোষ বিভাজনে বাধা দেয়। এমনকি ক্যান্সারের কোষ বিনষ্ট করতেও সাহায্য করে। তাই প্রতিদিন ২৩৭ মিলিলিটার বেদানার রস খেলে প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে আসে।

এছাড়া, আজকের বিশ্বে নারীদের স্তন ক্যান্সার একটি বিরাট সমস্যা। পুরুষদের প্রোস্টেট ক্যান্সার ঠেকানোর পাশাপাশি নারীদের স্তন ক্যান্সার রোধেও ডালিম বেশ কার্যকরী। পাশাপাশি, অ্যানিমিয়া রোগীদের জন্য ডালিমের রস খুবই উপকারি।

7.ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধ করে

দেহে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে ডালিমের রস। এছাড়া এটি ফাংগাস ইনফেকশনের বিরুদ্ধেও কঠোর ভূমিকা রাখে। মুখের ভিতরে ঘা, দাঁতের সমস্যা, মাড়ি ফোলা এগুলি সবই আমাদের কাছে খুব পরিচিত সমস্যা। এই সব রোগের পিছনে মূলত ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস অনেকাংশে দায়ি। ডালিমের ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী গুণাগুণ এই সব জীবাণুদের মেরে ফেলে এবং এইসব রোগের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে সাহায্য করে।

8-রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

সুস্থ থাকার জন্য শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। চিকিৎসক এবং পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী না হলে অল্প অসুস্থতাতেও মানুষ খুব সহজে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগের আক্রমণও জোরালো হয়। আর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ডালিমের রস খুব উপকারী। কারণ, ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী গুণাগুণ আছে ডালিমে। শরীরের ক্ষতিকর ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়ার পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ডালিমের রস।

ডালিমের মধ্যে প্রচুর পটাশিয়াম ও ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। এটার অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট গুণ গ্রিন টি বা রেড ওয়াইনের থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি। ডালিমের মধ্যে রয়েছে তিন প্রকার অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যথা: ট্যানিন, অ্যান্থো সিয়ানিন ও এলাজিক অ্যাসিড। অ্যান্থোসিয়ানিন দেহ কোষ সুস্থ রাখে, ফলে শরীর ভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে পারে। এছাড়াও, সুস্থ থাকার জন্য কিংবা ভালো পারফর্মেন্সের জন্য অনেকেই শারীরিক অনুশীলন করে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনুশীলনের পাশাপাশি ডালিম খাওয়া শুরু করলে শারীরিক কার্যক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পেতে শুরু করবে।

9.তারুণ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে

ডালিম ত্বক সুস্থ রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটাতে অবস্থিত ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন সি, সাইট্রিক আসিড ও ট্যানিন ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ডালিমে অবস্থিত পোমেগ্র্যানেট অয়েল ত্বকের ময়শ্চারাইজার হিসেবে ভালো কাজ করে। যেটা ত্বকের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

এছাড়া, ডালিম উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে বাধা দেয়। সূর্যের তাপ ও পরিবেশের ক্ষতিকারক পদার্থ ত্বকের যে ক্ষতি করে সেগুলো থেকে রক্ষা করে ডালিমের রস। এছাড়াও, ডালিম শরীরের কোলাজেন ও এলাস্টিন উৎপাদনে সাহায্য করে। এই দুই উপাদান ত্বককে সাজীৰ ও তরতাজা রাখতে সাহায্য করে।

10.হজম শক্তি বৃদ্ধি করে

সুস্বাস্থ্যের জন্য হজমশক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এটি বাধাগ্রস্ত হলে বা কোন ধরণের সমস্যা দেখা দিলে পুরো দেহই স্থবির হয়ে পড়তে পারে। আর হজম শক্তি বাড়াতে ডালিমের আঁশ খুবই উপকারী। করণ, ডালিমে দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় দুই ধরনের ডায়াটারি ফাইবার থাকে যেটা হজমশক্তি বাড়ায় এবং অন্ত্রের নড়াচড়া নিয়মিত করে।

এছাড়া, আমরা প্রতিদিন সবজি ও ফলমূল না খেয়ে নানান ‘জাঙ্ক ফুড’ খেয়ে থাকি যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। প্রতিদিনের আঁশের চাহিদা মেটানোর জন্য খাদ্য তালিকায় ডালিম যোগ করে নিন। কারণ, একটি ডালিমে ৪৫ শতাংশ আঁশ থাকে, যা প্রতিদিনের আঁশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম।

11.সর্দি-কাশি দূর করে

সর্দি-কাশি, ঠাণ্ডা-কাশি, ঠাণ্ডা লাগা বা সর্দি-জ্বর এক ধরনের ভাইরাস ঘটিত সংক্রামক রোগ যা মানবদেহের ঊর্ধ্ব শ্বাস পথ, বিশেষ করে নাকে আক্রমণ করে। এছাড়া এই রোগে গলবিল, অস্থি গহ্বর ও স্বরযন্ত্রও আক্রান্ত হতে পারে। ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হবার দুই দিন পর বা তারও আগেই এই রোগের লক্ষণ ও উপসর্গগুলি প্রকাশ পায়।

আর, সর্দি কাশি দূর করতে ডালিমের রস দারুন ভাবে সাহায্য করে। ডালিমে রয়েছে পটাশিয়াম ও ফাইবার যা ইমিউন সিস্টেম মজবুত রাখতে সাহায্য করে। তাই সর্দি-কাশি থেকে রক্ষা পেতে ডালিমের রস ওষুধ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া, ঠান্ডায় খুব বেশি কাবু হয়ে গেলেও বেদানার রস খেতে পারেন।

12.ডালিমের অন্যান্য উপকারিতা

উপরোক্ত উপকারিতা ছাড়াও, ডালিমের আরো অন্যান্য নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। যেমন:

  • ডালিম গাছের পাতা বেটে মধু ও দধি একসাথে মিশিয়ে সেবন করলে গর্ভপাতের আশংকা দুর হয়।
  • ডালিমে উপস্থিত রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট যেটা দাঁতে প্লাক জমতে বাধা দেয়। আবার, জিন জিভাইটিস নামে মাড়ির রোগ প্রতিরোধ করতে বেদানার ভূমিকা অপরিসীম। তাই আমাদের দাঁত ভালো রাখার জন্য প্রতিদিন অল্প হলেও বেদানা খাওয়া উচিত।
  • রক্তস্বল্পতা দূর করার জন্য বেদানাতে রয়েছে প্রচুর আয়রন। এছাড়া, রুচি বৃদ্ধি, কোষ্ট কাঠিন্য রোধ, জন্ডিস, বুক ধড়ফড়ানি, বুকের ব্যথা, কাশি, কণ্ঠস্বর পরিষ্কার করতে সাহায্য করে ডালিম।
  • পুরনো পেটের অসুখ ও জ্বর সারাতেও সাহায্য করে এই ফল। চোখের দৃষ্টিশক্তি উন্নত করার পাশাপাশি স্মৃতিশক্তি বাড়াতে অনন্য ভূমিকা পালন করে ডালিম।
  • যারা বাতজনিত সমস্যায় ভোগেন তারা নিয়মিত ডালিম খেতে পারেন। কারণ ডালিম বাতজনিত সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে।
ডালিমের উপকারিতা

সামারি

উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা আমরা খুব সহজেই বলতে পারি ডালিম মানব জীবনের জন্য অত্যন্ত উপকারী একটি ফল। আর এই স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা ভেবে অনেকেই নিয়মিত ডালিম খেয়ে থাকেন। ডালিম একটি প্রায় চর্বিমুক্ত ফল। তাই এটার ক্ষতিকর প্রভাবও অনেক কম। তাই আপনার স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা চিন্তা করে, আজ থেকে আপনিও নিয়মিত ডালিম খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন।

Leave a Comment