খুব গুরুত্বপূর্ণ ১১টি লেবু পানির স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং সাবধানতা
(লেবু পানির স্বাস্থ্য উপকারিতা)
শারীরকে সুস্থ রাখতে পানির গুরুত্ব কতটা তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এই পানির সাথে সামান্য পরিমাণ লেবুর রস বা লেবু মিক্স করে দিলে এটা হতে পারে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার একটি অন্যতম সমাধান। কারণ লেবু পানির স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক।
এতে রয়েছে বিভিন্ন রকম প্রয়োজনীয় মিনারেল এবং ভিটামিন যেগুলো শরীরকে আর্দ্র রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া এটাকে শক্তিবর্ধক এবং বিপাকক্ষমতা বাড়ানোর অন্যতম একটি খাবার হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
নিচে লেবু পানির স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। তাই পড়তে থাকুন –
লেবু পানির স্বাস্থ্য উপকারিতা
1.ভিটামিন সি’র খুব ভালো একটি উৎস
একজন সুস্থ সবল প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ভিটামিন সি’র চাহিদা থাকে ৬৫-৯০ মিলিগ্রাম। আর একটি লেবুতে ১৮ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি পাওয়া যায়। তাহলে এইসব অনুযায়ী, দিনে দুই থেকে তিন বার লেবু পানি পান করলে শারীরিক ভিটামিন সি’র চাহিদার বেশিরভাগ অংশ পূরণ করা সম্ভব।
এছাড়াও, লেবু পানিতে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস সহ অন্যান্য আরো অনেক উপাদান রয়েছে। যেগুলো শরীরের ভেতরে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করে শরীরকে কর্মঠ রাখতে সাহায্য করে।
2.ত্বকের যত্নে লেবু
লেবুতে অবস্থিত ভিটামিন ‘সি’ দেহের ত্বক ও টিস্যুর জন্য অত্যন্ত উপকারী। লেবুতে উপস্থিত ভিটামিন সি ত্বকের কোষের ক্ষয় প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। গবেষকদের মতে, লেবুতে উপস্থিত ভিটামিন সি ত্বকে বলিরেখা পড়তে দেয় না।
শুধু তাই নয়, এই উপাদান শরীরে কোলাজেন তৈরি করে। যা মুখের অবাঞ্ছিত দাগ দূর করে ঔজ্জ্বলতা ফিরিয়ে আনে। পাশাপাশি, সূর্যের ক্ষতির হাত থেকে ত্বককে রক্ষা করে, ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে বাধা দেয়।
বেশ কিছু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে প্রাকৃতিক ভাবে ভিটামিন-সি গ্রহণ করলে অথবা ভিটামিন সি সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করলে নিজেকে ত্বকের বিভিন্ন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করা যায়।
3.ওজন কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে
আপনি যদি অতিরিক্ত ওজন কমানোর কথা চিন্তা করেন, তাহলে লেবু পানি আপনার খুব ভালো বন্ধু হতে পারে। কারণ, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, লেবু পলিফেনল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর একটি ভালো উৎস। এটির কাজ, ওজন বাড়তে দেয় না পাশাপাশি স্থূলতা কমাতে সাহায্য করে।
এছাড়া, লেবুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে। যা ক্ষুধার বিরুদ্ধে ভালো কাজ করে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খালি পেটে লেবুর রস খান, তাদের ওজন দ্রুত হ্রাস পায়। আবার, পুষ্টিবিদরা বলেছেন, একশ গ্রাম লেবুতে কেবলমাত্র ১৯ ক্যালরি থাকে। সে কারণে লেবু ওজন হ্রাসে দারুণ কাজ করে।
4.শরীরের পানি শূন্যতা দূর করতে বেশ উপকারী
শরীরের প্রতিটি কোষ, অঙ্গ ও টিস্যু পানির ওপর নির্ভরশীল। তাই সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষের প্রতিদিন অন্তত 4 লিটার পানি পান করা প্রয়োজন। আর এই পানিস্বল্পতা দূর করতে লেবু পানি দারুন উপকারী।
লেবু পানি আমাদের দেহে যথেষ্ট পরিমাণে ইলেক্ট্রলাইটস এর যোগান দিয়ে থাকে, যেটা দেহের পানিশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়া, লেবুর গুণ আপনাকে সরাসরি হাইড্রেট রাখবে না। তবে লেবুর স্বাদ এ বিষয়ে পালন করতে পারে এক অনন্য ভূমিকা।
5.হজমের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে খুবই কার্যকরী
বর্তমান সময়ে হজমের সমস্যা অতি প্রচলিত একটি সমস্যা। যার খুব ভালো কার্যকরী একটি সমাধান হলো কুসুম গরম লেবুপানি। লেবু-সরবত রক্ত পরিশোধনে সাহায্য করে। পাশাপাশি বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং শরীরের দুষিত পদার্থ অপসারণ করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
কারণ, লেবু পানিতে যে এসিড থাকে এটা খাবার হজম করতে সাহায্য করে। এছাড়া, এতে আছে সাইট্রাস ফ্লাভোনইডস যা পাকস্থলীতে খাদ্য কণাগুলোকে ভেঙে খুব সহজেই হজম করে ফেলে। এছাড়াও, পানির সাথে কয়েক টুকরা লেবু বা কুচি করা লেবুর খোসা মিশিয়ে খেলেও আপনি পেকটিনের উপকার পাবেন।
6.ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে লেবু পানির উপকারিতা
বর্তমান বিশ্বে ক্যান্সার একটি ভয়ংকর ব্যাধি হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ সালে গোটা বিশ্বে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৯৬ লক্ষ মানুষের মৃত্যু বরণ করেছেন। কিন্তু সুখবর হলো, ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পর সুস্থতার সংখ্যাও বাড়ছে প্রতি বছর।
আর লেবু পানি এই মরণব্যাধি ক্যান্সার প্রতিরোধ করতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। লেবুতে আছে এলকালাইন নামক এক ধরনের উপাদান। আর বিজ্ঞানীদের মতে ক্যান্সারের কোষ আর এই এলকালাইন উপাদান এক সাথে থাকতে পারেনা।
লেবুর রস ক্যান্সারের কোষ গুলোকেও ধ্বংস করতে পারে। এছাড়াও, আঁশ জাতীয় খাবার ক্যান্সার প্রতিরোধে বেশ সহায়ক। ভিটামিনের মধ্যে এ, সি, ই, বিটা ক্যারোটিন জাতীয় খাবার পাকস্থলি, লিভার, মলদ্বার, প্রোস্টেট, জরায়ু, স্তন, ফুসফুস ও অগ্নাশয়ের ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
7.কিডনির সাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে
কিডনিতে পাথর এই সমস্যাটি বর্তমান সময় খুব কমন একটি বিষয়। ওষুধ খেয়ে, অপারেশন করে বা লেজার চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগটি নিরাময় করা যায়। কিন্তু এ রোগটি যেন না হয় তাই আগে থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। পানি স্বল্পতা বা ডিহাইড্রেশন কিডনিতে পাথর জমার অন্য দামে একটি কারণ।
আর আমরা আগেই জেনেছি, লেবু পানি পান করলে আপনার শরীরে পানির অভাব দূর হবে। পাশাপাশি কিডনিতে পাথর জমার আশঙ্কাও কমে যাবে। আবার, পিত্তরস খাবার হজমে বিশেষ করে চর্বি জাতীয় খাবার হজমে সাহায্য করে।
আর লেবুর রসে রয়েছে চর্বি বিরোধী উপাদান, যাহা চর্বিকে গলাতে সাহায্য করে। তাছাড়া পিত্তথলির পাথর দূর করতে দরকার উচ্চ ফাইবার বা আঁশ যুক্ত খাবার। যেটা লেবুর মধ্যে প্রচুর পরিমানে রয়েছে।
8.রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে
চিকিৎসক এবং পুষ্টিবিজ্ঞানীরা মতে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী না হলে অল্প অসুস্থতাতেও মানুষ খুব সহজে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগের আক্রমণও জোরালো হয়। আর টক জাতীয় যেকোনো ফল, যেমন- লেবুতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি রয়েছে, যেটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
এছাড়াও লেবুতে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যার প্রভাবে শরীরে কোনো রোগ জীবাণু খুব সহজে বাসা বাঁধতে পারে না। তাই যেকোনো ধরনের ইনফেকশন বা অসুস্থতা এড়াতে নিয়মিত লেবু খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। এছাড়া, লেবুতে রয়েছে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম ও ফসফরাস,ফলিক এসিড, অ্যাসকরবিক এসিড ইত্যাদি।
9.গর্ভবতী মায়েদের জন্য অনেক উপকারী
গর্ভবতী মায়েদের জন্য লেবু পানি খুবই উপকারী। কারণ এটি দেহের ভাইরাস ধ্বংস করে ও হাড়ের টিস্যু মজবুত করে। তাছাড়া, এটা শুধু মায়ের শরীরই ভালো রাখে তা-নয়। বরং গর্ভের শিশুরও অনেক বেশী উপকার করে থাকে। কারণ, লেবুর সিপটাশিয়াম ও ভিটামিন সি শিশুর হাড়, মস্তিষ্ক ও দেহের কোষ গঠনে সহায়তা করে।
এছাড়াও, 2014 সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সব মায়েরা নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করেন এবং প্রতিদিন লেবু পানি পান করেন, তাদের তুলনায় যে মায়েরা নিয়মিত হাটেন না এবং লেবুর পানি পান করেন না তাদের রক্তচাপ বশী ছিল।
10.নিশ্বাসে সজীবতা আনতে সাহায্য করে
আমাদের খাওয়ার পর অনেক সময় মসলা- পেঁয়াজ, রসুন বা মাছের গন্ধ মুখে লেগে থাকে। মুখের এই দুর্গন্ধ বা নিশ্বাসের দুর্গন্ধ থেকে মুক্তি পেতে খাওয়ার পর এক গ্লাস লেবু পানি পান করতে পারেন। কারণ, মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে এবং মাঢ়ির রক্তক্ষরণ কমাতে লেবু পানি খুব উপকারী।
লেবুতে উপস্থিত সাইট্রাস খুব সহজেই মুখের ভেতর ব্যাকটেরিয়া হওয়ার আশঙ্কা রোধ করে। আর তাই মুখে দুর্গন্ধ হয় না। তবে লেবুর এসিড দাঁতে অতিরিক্ত পরিমাণ পড়লে দাঁতের এনামেল নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
11.লেবু পানির অন্যান্য উপকারিতা
উপরোক্ত উপকারিতা ছাড়াও লেবু পানির আরো অন্যান্য অনেক উপকারিতা রয়েছে। যেমন:
- লেবু পানি কফ দূর করতে সাহায্য করে। ফলে শ্বাস নেওয়ার সমস্যা দূর হয়। হাঁপানি রোগীদের জন্যও এটি বেশ উপকারী।
- আবার, যদি মূত্রনালীতে সংক্রমণ ঘটে। তাহলে প্রচুর পরিমাণে লেবুর রস পান করুন। এটি আরোগ্য লাভে সাহায্য করবে। লেবু পানি শরীরের রক্তবাহী ধমনী ও শিরাগুলোকে পরিষ্কার রাখতেও সাহায্য করে।
- Joslin Diabetes Center-এর পরামর্শ অনুযায়ী দিনে ২০-৩৫ গ্রাম ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া দরকার। মাঝারি আকারের একটি লেবুর রস থেকে 2.4 গ্রাম ফাইবার পাওয়া যায় যা একজন ডায়াবেটিক রোগীর শরীরে ৭-১২% ফাইবারের চাহিদা পূরণ করে।
- এছাড়া, দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ কমানোর ক্ষমতাও রয়েছে লেবুর সরবতে। এছাড়া, গরমের দিনে অনেকের শরীর প্রচণ্ড ঘেমে যায়। ফলে শরীরে ব্লাড সুগার লেভেল কমে যায় এবং ক্লান্ত হয়ে যাই। লেবু পানিতে চিনি মিশিয়ে পান করলে ব্লাড সুগার লেভেল বেড়ে যায় এবং ক্লান্তিটাও দূর হয়।
- 70,000 মহিলাদের উপর 14 বছরের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সবথেকে বেশি সাইট্রাস ফল খেয়েছেন তাদের মধ্যে ইস্কেমিক স্ট্রোকের ঝুঁকি 19 শতাংশ কম ছিল। ইস্কেমিক স্ট্রোক হলো সবচেয়ে সাধারণ ধরণের একটি স্ট্রোক। যখন রক্ত জমাট বেঁধে মস্তিস্কে রক্ত প্রবাহকে বাধা দেয় তখন এটি হয়।
লেবু পানি তৈরি করার সঠিক নিয়ম
লেবু পানির সম্পূর্ণ উপকারিতাটা পেতে হলে, প্রথমে চিনি ছাড়া এক গ্লাস ঠান্ডা অথবা গরম পানিতে সমপরিমাণ লেবুর রস মিশিয়ে নিন। প্রোপারলি লেবুর রস বের করার জন্য জুসারও ব্যবহার করতে পারেন।
এটা থেকে লেবুর কিছু তেলও বের হবে, আর এটাও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তারপর লেবুর রস এবং পানি খুব ভালোভাবে মিশিয়ে নিন। তারপর এটি পান করার উপযোগী হলে পান করুন।
এটা আপনার স্নায়ুর কার্যক্রমকে ভালো রাখতে সাহায্য করবে। বিষণ্ণতা দূর করবে, পটাশিয়ামের মাত্রা বাড়াবে এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করবে।
সাবধানতা
আমরা আগেই জেনেছি, লেবু পানির স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক, কিন্তু এটা পান করার সময় অবশ্যই কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন:
- গরম পানিতে সাইট্রিক অ্যাসিডের কার্যক্ষমতা ভীষণভাবে বেড়ে যায়, ফলে এসিডিটি বেড়ে যেতে পারে।
- লেবু অতিরিক্ত এসিড সমৃদ্ধ হওয়ায় অন্যান্য কোমল পানীয়র মত অতিরিক্ত লেবুর রস পান করার ফলে দাঁতের ক্ষয়রোগ সৃষ্টি হতে পারে। দাঁত ভালো রাখতে লেবু পানি খাওয়ার পরে ব্রাশ করে নিতে পারেন।
- বিশেষজ্ঞদের মতে, আপনি যদি মাইগ্রেনের সমস্যায় ভুগে থাকেন তবে বেশি লেবু পানি খাওয়া থেকে বিরত থাকাই আপনার জন্য ভালো। হয়তোবা এটি আপনার মাইগ্রেনের সমস্যা সৃষ্টির কারণ হতে পারে অথবা আপনার মাইগ্রেনের সমস্যা ফিরিয়ে আনতে পারে।
- আবার স্থূলকায় হওয়ার পরও যাদের ব্লাড প্রেসার লো, তাদের প্রেসার আরও লো করে দেয় এই লেবু গরম পানি।
সামারী
সকালে ঘুম থেকে উঠে চা বা কফির পরিবর্তে এক গ্লাস করে লেবুর পানি পান করার অভ্যাস করতে পারেন। এটি দেহে পুষ্টি, ভিটামিন ও মিনারেলস যোগাতে সাহায্য করে। লেবুপানি আমাদের দেহে প্রাকৃতিক ভাবে শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আমাদের শরীর পানিশূন্যতা থাকে এবং এই ঘাটতি পূরণ করতে প্রয়োজন পানি, যেটা দেহ থেকে টক্সিন বের করে দেয় ও কোষগুলো সজীব করে। তবে যাদের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আছে তাদের চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই এই পানীয় পান করা উচিত।
3 Comments