চর্বি জাতীয় খাবার: পুষ্টিবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিশ্লেষণ
(চর্বি জাতীয় খাবার গুলো কি কি)
মানব শরীরের সুস্থতা বজায় রাখার জন্য চর্বি একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি, চর্বি কোষের ঝিল্লী গঠনে, হরমোন এবং অন্যান্য জৈব-রাসায়নিক পদার্থ তৈরিতে, এবং চর্বি-দ্রবণীয় ভিটামিন শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে, সকল চর্বি সমান নয়। বিভিন্ন ধরণের চর্বির ভিন্ন ভিন্ন গঠন ও কার্যকারিতা রয়েছে, যা আমাদের স্বাস্থ্যের উপর বিরাট প্রভাব ফেলে। চলুন তাহলে চর্বি জাতীয় খাবার গুলো কি কি, এটার উপকারিতা, কিভাবে স্বাস্থ্যকর চর্বি জাতীয় খাবার নির্বাচন করবেন ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি-
চর্বির শ্রেণিবিভাগ
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট
- মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট
- পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট
- ট্রান্স ফ্যাট
স্যাচুরেটেড ফ্যাট
কোন কার্বন চেইন ডবল বন্ড ছাড়া গ্লিসারাইড চর্বিগুলিকে স্যাচুরেটেড বলা হয়। বেশিরভাগ প্রাণীর চর্বি স্যাচুরেটেড। উদ্ভিদ ও মাছের চর্বিতে সাধারণত স্যাচুরেটেড থাকে না বললেই চলে। স্যাচুরেটেড ফ্যাট শরীরের জন্য ক্ষতির কারণও হতে পারে।
উৎস: প্রাণীজ খাবার, যেমন লাল মাংস (গরুর মাংস, খাসির মাংস, শুয়োরের মাংস), পূর্ণ-চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার (পূর্ণ-চর্বিযুক্ত দুধ, দই, পনির), নারকেল তেল, ককোয়া মাখন, পাম কার্নেল তেল ইত্যাদিতে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি পাওয়া যায়।
ক্ষতিকর প্রভাব: অতিরিক্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ রক্তে LDL (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও উচ্চরক্তচাপ, ক্যান্সার, স্থূলতা, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা সহ আরো অন্যান্য কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
সীমাবদ্ধতা: স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণ সপ্তাহের মোট ক্যালোরির 10% এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত।
মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট
জৈব রসায়ন এবং পুষ্টিতে, মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট হল একটি চর্বি যাতে একটি মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড ( MUFA ), ফ্যাটি অ্যাসিডের একটি উপশ্রেণী থাকে যা ফ্যাটি অ্যাসিড শৃঙ্খলে একটি ডবল বন্ধন দ্বারা চিহ্নিত করা হয় এবং বাকি সমস্ত কার্বন পরমাণু একক বন্ধনযুক্ত থাকে । বিপরীতে, পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (PUFAs) এর একাধিক ডবল বন্ড রয়েছে। সহজে বলা যায়, মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট হল একটি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড ধারণকারী ট্রাইগ্লিসারাইড।
উৎস: অ্যাভোকাডো, বাদাম (আখরোট, বাদাম, পেস্তা), জলপাই তেল, ক্যানোলা তেল, উদ্ভিদ তেল ইত্যাদিতে পাওয়া যায়।
উপকারিতা: LDL (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে এবং HDL (ভাল) কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এবং হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। পাশাপাশি, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করে।
পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট
পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট হল এক ধরনের চর্বি যাতে একটি পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে।
উৎস: মাছ (স্যামন, সার্ডিন, ম্যাকারেল), বীজ (আখরোট, চিয়া বীজ, ফ্ল্যাক্সসিড), বাদাম (আখরোট, সব ধরনের বাদাম)। এছাড়াও, সেসেমি অয়েল, সূর্যমুখীর তেল, কর্ন অয়েলে, সয়বিন তেলে প্রচুর পরিমাণ পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে।
উপাদান: ওমেগা-3 এবং ওমেগা-6 ফ্যাটি অ্যাসিড এই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এই অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিড শরীর দ্বারা তৈরি করা যায় না।
উপকারিতা: হৃদরোগ, প্রদাহ, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি, চোখের বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি কমাতে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
ট্রান্স ফ্যাট
নানা রকমের শর্করা ও স্নেহ জাতীয় খাবারকে যখন কৃত্রিম উপায়ে চর্বি জাতীয় পদার্থে পরিবর্তিত করা হয় তখন ট্রান্স ফ্যাট বলে।
উৎস: প্রক্রিয়াজাত খাবার (ফাস্ট ফুড, প্যাকেজড খাবার), ভাজা খাবার, কিছু মার্জারিন, সিঙ্গাড়া, সমুচা, পুরি, বিস্কুট, চানাচুর, চিপস। এছাড়া উচ্চ তাপমাত্রায় দাহ্য তেল বা চর্বিও ট্রান্স ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। এছাড়াও, পাই ক্রাস্ট, পিষ্টক মিশ্রণ, নন ডেইরি কফি ক্রিমারস ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণ ট্রান্স ফ্যাট হয়েছে।
ক্ষতিকর প্রভাব: টাইপ-২ ডায়াবেটিস ও স্ট্রোকের ঝুঁকি পায়। এছাড়া হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২১ শতাংশ এবং হৃদরোগজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। শরীরে কম ঘনত্বের কোলেস্টেরলের (এলডিএল) পরিমাণ বেড়ে যায়।
স্বাস্থ্যকর চর্বিজাতীয় খাবার নির্বাচন
- উচ্চ মনো-অনস্যাচুরেটেড এবং পলি-অনস্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত খাবার বেছে নিন।
- সংযুক্ত ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার সীমিত করুন।
- পরিমিত পরিমাণে চর্বিজাতীয় খাবার খান।
- খাদ্যের লেবেল পড়ুন এবং চর্বির পরিমাণ পরীক্ষা করুন।
আরো পড়ুন: আমিষ জাতীয় খাবার: একটি বিস্তারিত এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা
উপসংহার
চর্বি আমাদের শরীরের একটি অপরিহার্য পুষ্টি উপাদান। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে বিভিন্ন উৎস থেকে স্বাস্থ্যকর চর্বি গ্রহণ নিশ্চিত করুন। স্যাচুরেটেড ফ্যাট কমিয়ে, মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট, বিশেষ করে ওমেগা-3 এবং ওমেগা-6 ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবার বেশি খাওয়ার চেষ্টা করুন। স্বাস্থ্যকর চর্বি গ্রহণের পাশাপাশি সামগ্রিক স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসব্জি, ফল, ও পূর্ণ শস্য খাওয়ার অভ্যাস করুন।