Health Tips

মদ খাওয়ার সবথেকে ক্ষতিকর প্রভাব গুলো কি?

মদ খাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব

বিভিন্ন ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাচীনকাল থেকেই মানব সমাজে মদ্যপানের প্রচলন রয়েছে। মদ বা এলকোহলযুক্ত পানীয় এক ধরনের পানীয় যাতে ইথানল যুক্ত করা থাকে। এই ইথানল একটি স্নায়ু সংবেদনশীলতা অবদমক।

ধারণা করা হতো, এটি অল্প পরিমাণে পান করলে মনে উৎফুল্ল ভাব সৃষ্টি হয়, দুঃশ্চিন্তা কমে যায় এবং সামাজিকভাবে মেলামেশা করার ইচ্ছা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানীদের দাবি, মদে অভ্যস্ত ব্যাক্তি হিংসাত্মক হয় এবং অনেকসময় মদ্যপানের কারণে নিজেই নিজের ক্ষতি করে ফেলে।

এখন প্রশ্ন হলো: তাহলে বিশেষজ্ঞদের মদ সম্পর্কে আগেকার ধারণা কি ভুল? যদি ভুল হয় তাহলে সত্যটা কি? চলুন তাহলে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো জানার চেষ্টা করি।

মদ্যপান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অতীত এবং বর্তমান মতামত

মদ্যপান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের অতীত এবং বর্তমান মতামত

দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে আসছিল, পরিমিত মদ্যপানের কারণে স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হয় না। বরং কিছু ক্ষেত্রে এটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। কিন্তু সম্প্রতিক এক গবেষণায় এই তথ্যকে ভুল প্রমাণিত করেছেন গবেষকরা।


গবেষকদের মতে, মদ মানেই ক্ষতি। মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। মদ পান করলে ক্ষতি হবেই।
এছাড়া, যুক্তরাজ্যের সরকারি নির্দেশিকায় ওই একই কথা বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যগত ক্ষতির দিক থেকে বিবেচনা করলে মদ্যপানের কোন ‘নিরাপদ’ সীমা নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তাদের একটি প্রতিবেদনে জানায়, মদ্যপানের কারণে প্রতি বছর ৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৭ সালে শুধু ইংল্যান্ডেই মদ্যপান জনিত কারণে ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ হাসপাতালে ভর্তিহয়েছিলো। মানবদেহের এমন কোনো সিস্টেম নেই যা মদ্যপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত।

ব্রিটেনের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট’র তাদের একটি প্রবন্ধে বলেন, বিশ্বে প্রতি তিনজন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ মদ পান করেন। আর অপরিণত বয়সে মৃত্যু ও প্রতিবন্ধিতার জন্য সপ্তম ঝুঁকিপূর্ণ অভ্যাস হল এই মদ্যপান।

এককথায় বর্তমানে বিশেষজ্ঞদের দাবি মদ্যপানের কোন নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। যেকোন পরিমাণ মদ্যপানই শরীরের জন্য ক্ষতিকর।

যেহেতু একাধিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে মদ্যপান শরীরের জন্য ক্ষতিকর, তাই চলুন মদ্যপানের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি।

মদ খাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব

মদ খাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব

আমরা আগেই জেনেছি যেকোন পরিমাণ মদ্যপানই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর মদ্যপানের সবথেকে বেশি শারীরিক ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, এটা মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে ফেলে। ফলে, যক্ষা, ক্যান্সার ও নিউমোনিয়ার মতো রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়।

তাই যাদের ফ্লু, সর্দি, নাক দিয়ে রক্ত ​​পড়া ইত্যাদি সমস্যা আছে তারা মদকে একেবারেই না বলুন। কারণ এই পরিস্থিতিতে মদ্যপান করলে সমস্যা আরও বেড়ে যাবে।

পাশাপাশি, হাঁড় ক্ষয়, হাঁড় পাতলা হয়ে যাওয়া, হাঁড় ভাঙ্গা বৃদ্ধি পাওয়া, পেশী দুর্বল ও সংকুচিত হওয়া, পুরুষের ক্ষেত্রে ইরেকটাল ডিজফাংশন এবং মহিলাদের ক্ষেত্রে মাসিকের সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব এবং স্তন ক্যান্সারের মতো রোগ খুব সহজেই শরীরে বাসা বেঁধে ফেলে।

এছাড়া, যেসকল প্রাপ্তবয়ষ্ক ব্যক্তি অতিরিক্তি মদ্যপান করেন তাদের নিঃসৃত শ্বাসে নাইট্রিক অক্সাইডের মাত্রা যারা মদ্যপান করেন না তাদের তুলনায় কমে যায়।

এক জরিপে দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়ার 16 থেকে 85 বছর বয়সী প্রায় 20 পার্সেন্ট লোক মদ্যপানের কারণে মানসিক সমস্যায় ভোগে। ২০০৪ সালে মেক্সিকোর করা এক গবেষণার রিপোর্টে বলা হয়েছে, মদ্যপানে আসক্ত স্বামী দ্বারা ৭৩% নারী উদ্বেগ, ভয় এবং বিষণ্নতায় ভুগে, ৩১% শিশুদের পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার স্বীকার হতে হয় এবং ৬২% স্ত্রী শারীরিক এবং মৌখিক নির্যাতনের স্বীকার হয়।

কারণ, মদ্যপানকারী ব্যক্তি খুব সহজেই মাতাল হয়ে যায় তাই সাধারন ও স্বাভাবিকভাবে তারা চিন্তা করতে পারেনা। পাশাপাশি, মদ্যপানকারী ব্যক্তি রাতে ভালো ঘুমোতে পারেনা এবং স্বাভাবিকভাবে তাদের মতামতও প্রকাশ করতে পারেনা। যেটা তার দৈনন্দিন কার্যক্রমকে বাঁধাগ্রস্ত করে এবং সুখী জীবনকে বিষিয়ে তোলে।

অন্যদিকে নিয়মিত মদ্যপানের কারণে লিভারের মারাত্মক ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে মদ্যপানের কারণে লিভারের সাধারণত তিন ধরনের রোগ বেশি হয়ে থাকে। যেমন: (1) ফ্যাটি লিভার (2) লিভার সিরোসিস (3) অ্যালকোহলিক হেপাটাইটিস।

প্রাথমিক অবস্থায় ফ্যাটি লিভার ধরা পড়লেন নিয়মিত চিকিৎসা এবং মদ্যপান বন্ধের মাধ্যমে এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। অপরদিকে লিভার সিরোসিস একটি ভয়ঙ্কর রোগ। এই রোগের কারণে ক্যান্সারও হতে পারে।

বিশ্বের পঞ্চাশোর্ধ নারীদের মধ্যে ২৭.১ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ১৮.৯ শতাংশের ক্যান্সারে মৃত্যু হয় মদ্যপানের কারণে। শুধু যুক্তরাজ্যেই প্রতি ১৩ জন নারীর মধ্যে ১ জনের স্তন ক্যান্সার হয় মদ্যপানজনিত কারণে।

গবেষকদের মতে, একজন পুরুষের ক্ষেত্রে সপ্তাহে এক বোতল ওয়াইন খেলে যে পরিমাণ ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে, পাঁচটি সিগারেট খেলে সেই একই ঝুঁকি থাকে। আবার, একজন নারী যদি সপ্তাহে ৭৫০ মিলিলিটারে এক বোতল ওয়াইন খান বা সপ্তাহে ১০টি সিগারেট খান তাহলে তার ক্যান্সারের ঝুঁকি হবে একই সমান।

আবার বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, সারাবিশ্বে ৯.৮ শতাংশ মা গর্ভাবস্থায় মদ খান। গর্ভাবস্থায় মদ খান এমন ৬৭ জনের মধ্যে একজন মা বিভিন্ন রকম শারিরীক ও মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দেন।

মদের প্রভাবজনিত এই শারীরিক ও মানসিক সমস্যাকে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ‘ফিটাল অ্যালকোহল সিনড্রোম’ বা সংক্ষেপে ‘ফাস’ বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে জন্ম নেয়া শিশুদের পরিণত বয়সে একইসাথে একাধিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে।

অধিকাংশ মানুষের ধারণা মদ পান করলে যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে এটি একটি ভুল ধারণা। মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, মদ পান করলে মানসিক ও শারীরিক শিথিলতার কারণে যৌন উত্তেজনা হ্রাস পায়।

আবার, যারা স্বল্প পরিমাণে মদ্যপান করেন, তাদের তুলনায় যারা একেবারেই মদ পান করেন না, তাদের হৃদরোগের সম্ভাবনা একেবারেই কম। পাশাপাশি, তাদের উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও কম থাকে। আবার, মদ ফুসফুসের মধ্যকার স্বাস্থ্যকেও নষ্ট করতে সাহায্য করে।

এছাড়াও, মদ্যপানের কারণে বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় ১.২ শতাংশ, যক্ষায় ১.৪ শতাংশ, এবং নিজ দেহের ক্ষতির মাধ্যমে মৃত্যু হয় ১ শতাংশ মানুষের। এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বে সবথেকে বেশি মদ পান করে ডেনমার্কের মানুষ। আর বিশ্বের সবথেকে কম মদ পান করে মুসলিম দেশগুলো। কারণ ইসলামে মদ পান করা সম্পূর্ণ হারাম।

পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে – হে মুমিনগণ তোমরা মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ থেকে বিরত থাকো, যাতে তোমরা কল্যাণপ্রাপ্ত হতে পারো। কারণ এগুলো শয়তানের অপবিত্র কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। (সূরা আল মায়েদা – ৯০)।
তাই আমাদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলকেই মদ্যপান ত্যাগ করা উচিত।

মদ খাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব

সামারি

২০১৬ সালের বৈশ্বিক তথ্যে দেখা গেছে, ৬.৮ শতাংশ পুরুষ ও ২.২ শতাংশ নারীর অপরিণত বয়সে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো মদ্যপান।
বর্তমান সময়ে অ্যালকোহল পান করা কিছু লোকের শখ এবং পছন্দের হলেও, কিছু লোক ফ্যাশন এবং লাইফস্টাইল মেইনটেন করার জন্য পান করে থাকে।

কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, অনেক কীর্তিমান জাতি এই মাদকাসক্তির কারণেই বিপর্যস্ত হয়েছেন, সমাজে তৈরি হয়েছে বিবাদ ও অনিষ্টতা।

আর বর্তমানে বিজ্ঞানের কৃপায় আমরা এটাও জানতে পেরেছি মদের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। মদ খাওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। মদ যতটুকুই পান করা হোক না কেন, ততটুকুই ক্ষতিকর। তাই আসুন নিজেকে বাঁচাতে সবাই একসাথে মদকে পরিত্যাগ করি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button