টাইপ ২ ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিস কি এবং কত প্রকার
(টাইপ ২ ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিস কি)
‘ডায়াবেটিস’ শব্দটির সাথে আমারা সবাই অনেক পরিচিত। বর্তমান সময়, এমন কোনো পরিবার খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে পরিবারে কোনো ডায়াবেটিসের রোগী নেই। এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।
যেটা প্রতি একশত জনের মধ্যে প্রায় ছয় জন। আবার, প্রায় 4 মিলিয়নেরও বেশি মানুষ জানেন না যে, তাদের শরীরে ডায়াবেটিস আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, ডায়াবেটিস রোগটি এখন একটি মহামারি রোগ। এই রোগের অত্যধিক বিস্তারের কারণেই সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এমন ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে একটু সচেতন থাকলেই এই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ। কিন্তু আগে আপনাকে জানতে হবে বা বুঝতে হবে ডায়াবেটিস আসলে কি এবং কেন হয়। আর টাইপ ২ ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিস কি এটা বুঝতে হলে আপনাকে আগে জানতে হবে ইনসুলিন কি এবং এটার কাজ কি।
চলুন তাহলে স্টেপ বাই স্টেপ জানার চেষ্টা করি।
ইনসুলিন কি? বা ইনসুলিন এর কাজ কি?
ইনসুলিন ও ডায়াবেটিসের সম্পর্কটা খুব ঘনিষ্ঠ, অনেকটা তাপ ও তাপমাত্রার সম্পর্কের মতো। ইনসুলিন হল এক ধরনের প্রোটিনধর্মী হরমোন। যেটা মানবদেহের অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস অব ল্যাঙ্গারহান্টসের বিটা কোষ থেকে নিঃসৃত হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই হরমোনটি তৈরি হয় মানব দেহের প্যানক্রিয়াস নামের একটি অঙ্গ থেকে।
আর এই ইনসুলিনের কাজ হলো মানব দেহের প্রয়োজন ছাড়া গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে, দেহকে সঠিক পরিমাণে গ্লুকোজ সরবরাহ করতে সাহায্য করা। আরো ভালো ভাবে বলা যায়, আমরা প্রতিদিন যে খাদ্যই খাই না কেন, আমাদের শরীর তার বেশির ভাগ অংশই শর্করায় পরিণত করে। আর ইনসুলিন হরমোন এই শর্করাকে আমাদের শরীরের বিভিন্ন কোষে পৌঁছে দেয়।
কোষে শর্করা জারিত হয়ে শক্তিরূপে সঞ্চিত থাকে। আর এই শক্তির মাধ্যমেই আমরা প্রতিদিনের বিভিন্ন কাজকর্ম করে থাকি। ইনসুলিন ছাড়া, রক্তে শর্করা পৌঁছে দেয়ার আর কোনও উপায় নেই। তাই শর্করাকে শক্তিরুপে পরিণত করতে পুরো কৃতিত্বটাই ইনসুলিনের।
এবার চলুন ডায়াবেটিস কি? এটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস একটি হরমোনজনিত রোগ। রক্তে যখন গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন শারীরিক এই অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলে। আরও ভালোভাবে বলা যায়, দেহের ভিতরে অগ্নাশয় নামে একটি অঙ্গ রয়েছে যার একটি কাজ হচ্ছে ইনসুলিন হরমোন তৈরি করা।
আর এই অগ্নাশয় যদি শরীরের প্রয়োজন মত নির্দিষ্ট পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে অথবা ইনসুলিন পর্যাপ্ত উৎপন্ন হচ্ছে কিন্তু সেটা কোন কাজ করতে পারছে না অর্থাৎ নিষ্ক্রিয় থাকে, তাহলে শারীরিক এই অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলা হয়।
যখন কোন ব্যক্তির ডায়াবেটিস হয়, তখন ওই ব্যক্তির শরীরে ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ কমে যায়। ফলে দেহের কোষে পর্যাপ্ত গ্লুকোজ পৌঁছাতে পারে না। ফলে, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর এই অতিরিক্ত গ্লুকোজ প্রসাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এই কারণে ডায়াবেটিস রোগীর ঘন ঘন প্রস্রাব হয়।
যখন প্রস্রাব বেশি হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই রোগী তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন। অন্যদিকে, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ায় কারণে রোগীর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ গ্লুকোজ বের হয়ে যায়। তখন শারীরিক চাহিদা মত প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করতে পারে না দেহের কোষগুলো।
ফলে রোগী দুর্বলতা অনুভব করেন। এই সময়, রোগী যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারে, তবে তার রক্তনালি, স্নায়ু, কিডনি, চোখ ও হৃদ্যন্ত্রের সমস্যাসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডায়াবেটিস কত প্রকার ও কি কি
বিজ্ঞানীরা ডায়াবেটিসকে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন, যথা: (১) টাইপ-১ ডায়াবেটিস, (২) টাইপ-২ ডায়াবেটিস, (৩) জেস্টেশনাল বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস। (৪) প্রি ডায়াবেটিস।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস:- টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের অগ্লাশয়ের মধ্যে থাকা ইনসুলিন উৎপন্নকারী কোষগুলোকে ধংশ করে দেয়, ফলে শরীরের চাহিদা মত ইনসুলিন উৎপন্ন করতে পারে না। এই কারণে রোগীকে বাইরে থেকে শরীরের মধ্যে কৃত্রিম ইনসুলিন প্রবেশ করাতে হয়।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসকে বাচ্চাদের ডায়াবেটিস বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের ডায়াবেটিসও বলা হয়ে থাকে। কারণ, HLADR 4 এবং HLADR 3 নামের দুটি জিনের কারণে বাচ্চাদের এই টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। ১০ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্যে এই প্রকারের ডায়াবেটিস বেশি দেখা যায়।
এক কথায়, টাইপ-১ ডায়াবেটিস মূলত জেনেটিক কারণে অর্থাৎ জিনগত কারণে তরুণদের হয়ে থাকে। বিজ্ঞানীরা টাইপ-১ ডায়াবেটিস কে আবার দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। একটির নাম দিয়েছেন ‘টাইপ-১-এ’ ডায়াবেটিস এবং অন্যটির নাম দিয়েছেন ‘টাইপ-১-বি’ ডায়াবেটিস।
- টাইপ-১-এ এবং টাইপ-১বি ডায়াবেটিস:- ‘টাইপ-১-এ’ এবং ‘টাইপ-১বি’ ডায়াবেটিসটি অটোইমিউনিটির জন্য বিটা কোষ ধংশের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তবে এই রোগের সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় যে এটি হল এক প্রকারের অটো-ইমিউন রোগ। যেখানে শরীরের রোগ প্রতিরোধ কার্যক্রম পেনক্রিয়াসের ইনসুলিন উৎপাদনকারি কোষকে ধংস করে ফেলে।
টাইপ- 2 ডায়াবেটিস:- এই ধরনের ডায়াবেটিসের রোগীদের যে পরিমান ইনসুলিন প্যাংক্রিয়াস থেকে নির্গত হওয়ার কথা তার চেয়ে তুলনামূলক কম ইনসুলিন নির্গত হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই রক্তে সুগারের মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার ফলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। এই অবস্থাকে হাইপারগ্লাইসেমিয়া বলা হয়।
জেস্টেশনাল বা গর্ভকালীন ডায়াবেটিস:- অনেক সময় গর্ভবতী অবস্থায় প্রসূতিদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। আবার প্রসবের পর সেটা আর থাকে না। এটাকে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বা জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস বলা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের ডায়াবেটিস হলে গর্ভবতী, ভ্রুণ, প্রসূতি ও সদ্য-প্রসূত শিশু সকলের জন্যই বিপদজনক হতে পারে।
এই ধরনের রোগীদের প্রসব হাসপাতালে করানো উচিত। পাশাপাশি, বিপদ এড়ানোর জন্য গর্ভকালীন অবস্থায় প্রয়োজনে ইনসুলিনের মাধ্যমে এটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। মহিলাদের গর্ভাবস্থায় প্লাসেন্টা হরমন নি:সরণের কারণে এটা হয়ে থাকে।
প্রি ডায়াবেটিস:- এই ধরনের ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বল্প মাত্রায় বেড়ে যায়, যা চিকিৎসকের নিকট তাৎপর্যপূর্ণ নয়। তবে, এই অবস্থায় অসতর্ক থেকে গেলে, এটা পরবর্তিতে টাইপ-২ ডায়াবেটিস তৈরির রাস্তা পরিষ্কার করে দিতে পারে।
- ডায়াবেটিসের লক্ষণ গুলো কি জানতে এখানে ক্লিক করুন
সামারি
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যা রোগীদের কখনোই সম্পূর্ণ নিরাময় হয়না। যাইহোক, কিছু চিকিৎসার মাধ্যম, আমরা অবশ্যই এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আগের যুগে, এই রোগটি শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেই দেখা যেত ।
তবে বর্তমানে এই রোগটি যে কারওরাই মধ্যে ধরা পড়ছে। এর প্রধান কারণ হলো ভুল খাদ্যাভাস। সুষম খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাই চিন্তা না করে সতর্কতার সাথে এটাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করুন। অবশ্যই সফলতা আসবে।