Healthy and nutritious food

কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা: স্বাস্থ্যের জন্য অমৃত সমান

অনেকেই অবসর সময়ে শুকনো ফল খেতে পছন্দ করেন। সেই ধারাবাহিকতাই কিসমিস অনেকেরই পছন্দের ফল। কিসমিস বা মানকা একটি সুপরিচিত শুকনো ফল, যা আঙুর শুকিয়ে তৈরি করা হয়। এটি শুধু স্বাদেই অনন্য নয়, পুষ্টিগুণেও ভরপুর। সাধারণত মানুষ কিসমিস শুকনা বা অন্যান্য খাবারের উপকরণ হিসাবে খেতে পছন্দ করেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা আরো বেশি।

কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার প্রচলন প্রাচীন আয়ুর্বেদ ও ইউনানি চিকিৎসায় বর্ণিত রয়েছে। এটি শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী, বিশেষ করে হজমশক্তি বৃদ্ধি, রক্তশূন্যতা দূর করা এবং ত্বকের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করে।  

আজকের প্রবন্ধে কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা, অপকারিতা, খাওয়ার নিয়ম এবং ভেজানোর সঠিক নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর হয়েছে।

কিসমিসের পুষ্টিগুণ 

কিসমিসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইবার। নিচে কিসমিসের প্রধান পুষ্টি উপাদানগুলো দেওয়া হলো:  

  • প্রাকৃতিক শর্করা (ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ): দ্রুত শক্তি প্রদান করে।  
  • ক্যালসিয়াম ও বোরন: হাড় ও দাঁত মজবুত করে।  
  • পটাশিয়াম: হৃদযন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। 
  • আয়রন: রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সাহায্য করে।  
  • অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (পলিফেনলস, ফ্ল্যাভোনয়েডস): ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে লড়াই করে।  
  • ফাইবার: হজমশক্তি বৃদ্ধি করে ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।  
  • ভিটামিন সি, বি কমপ্লেক্স: রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।  
কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা

কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা  

১. হজমশক্তি বৃদ্ধি করে: 

কিসমিসে বিশেষ করে ভেজানো কিসমিসে রয়েছে উচ্চমাত্রার ডায়েটারি ফাইবার, যা হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে। ভিজিয়ে রাখলে কিসমিস নরম হয়ে যায় এবং এর ফাইবার সহজে হজম হয়। এটি পাচনতন্ত্রের এনজাইমগুলিকে সক্রিয় করে, ফলে বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস ও অ্যাসিডিটি কমে।  

২. রক্তশূন্যতা দূর করে 

কিসমিসে বিশেষ করে ভিজানো কিসমিসে প্রচুর পরিমাণে আয়রন, কপার এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্স রয়েছে। এই উপাদানগুলো শরীরে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সাহায্য করে। কিসমিসে থাকার কপার রক্তের লোহিত কণার পরিমাণ বাড়ায়। তাই,‌ প্রতিদিন ভিজানো কিসমিস খেলে রক্তাল্পতা দূর হয় এবং শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়ে।  

৩. হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে

ভিজানো কিসমিসে রয়েছে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের মতো শক্তিশালী উপাদান। এই উপাদান গুলো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। পাশাপাশি পটাশিয়াম হৃদপিন্ডের জন্য খুবই উপকারী একটি উপাদান। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) এর মাত্রা কমায়, রক্তনালির জৈব রসায়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে এবং ধমনীর স্বাস্থ্য রক্ষা করে। ফলে হার্ট সুস্থ এবং স্বাভাবিক থাকে।

৪. লিভার ডিটক্সিফাই করে 

ভিজানো কিসমিস লিভার থেকে টক্সিন বের করতে সাহায্য করে। এটি প্রাকৃতিকভাবে লিভার পরিষ্কার রাখে এবং ফ্যাটি লিভারের সমস্যা কমায়।  

৫. ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে  

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিসমিস খুবই ভালো এবং উপকারী একটি খাবার। কিসমিসে প্রাকৃতিক মিষ্টি থাকলেও এটি ফ্যাট-ফ্রি এবং ফাইবার সমৃদ্ধ, যা দীর্ঘক্ষণ পেট ভরিয়ে রাখে। ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এছাড়াও কিসমিসে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্লুকোজ, যা শরীরের শক্তি যোগায় এবং দুর্বলতা কমায়।

৬. হাড় ও দাঁত মজবুত করে

ভেজানো কিসমিসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও বোরন। এই উপাদান গুলো দাঁত এবং হাড়ের জন্য খুবই উপকারী। বোরন হাড় গঠন এবং ক্যালসিয়ামের সঠিক অবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ক্যালসিয়াম সরাসরি হাড় গঠন এবং মজবুত করে। এইজন্য নিয়মিত ভেজানো কিসমিস খাইলে হাড়ের ঘনত্ব বাড়ে এবং অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধ হয়। এছাড়া, এটি দাঁতের ক্ষয় রোধ করতেও খুবই উপকারী।

৭. ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী 

কিসমিসে বিশেষ করে ভেজানো কিসমিসে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ভিটামিন বি6, ক্যালসিয়াম পটাশিয়াম এবং মিনারেলের মতো একাধিক সব শক্তিশালী উপাদান রয়েছে। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং বলিরেখা কমায়।

অন্যান্য উপাদান গুলো ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেয়। পাশাপাশি, কিসমিস রক্ত পরিষ্কার করে ব্রণ ও অ্যালার্জি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি চুল পড়া রোধ করে নতুন চুল গজাতেও সহায়তা করে।  

৮. যৌন স্বাস্থ্য উন্নত করে

কিসমিসে একাধিক ভিটামিন, খনিজ এবং ক্যালসিয়াম রয়েছে। এই জন্যই, প্রাচীনকাল থেকেই কিসমিসকে প্রাকৃতিক অ্যাফ্রোডিসিয়াক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এটি স্পার্ম কাউন্ট বাড়ায় এবং যৌন শক্তি বৃদ্ধি করে।  

৯. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক 

যদিও কিসমিসে প্রাকৃতিক চিনি থাকে, তবুও এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স মাঝারি পর্যায়ের। ভিজানো কিসমিস ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।  এছাড়া কিসমিস চোখের যত্নেও বেশ উপকারী। এটাতে রয়েছে ভিটামিন এ, বিটা ক্যারোটিন এবং অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট। এই সবগুলো উপাদান চোখের জন্য খুবই উপকারী, এমন কি বয়স জনিত চোখের সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে।

১০. ক্যান্সার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে  

কিসমিসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি এবং ক্যাটেচিন রয়েছে। এই উপাদানগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ফ্রি রেডিকেলসের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে। অন্যদিকে, ক্যাটেচিন নামক শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যান্সার সেল গঠনে বাধা দেয়। বিশেষ করে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে এটি খুবই কার্যকরী।  

কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার সঠিক নিয়ম 

১.ভিজিয়ে রাখার পদ্ধতি  

  • ১০-১৫টি কিসমিস পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে নিন।  
  • এক কাপ গরম বা স্বচ্ছল পানিতে সারারাত (৮-১০ ঘণ্টা) ভিজিয়ে রাখুন।  
  • সকালে খালি পেটে কিসমিস ও সেই পানি একসাথে খান।  

২.খাওয়ার সময়  

  • সকালে খালি পেটে খাওয়া সবচেয়ে ভালো।  
  • বিকেলে বা রাতের খাবারের পরও খেতে পারেন।  

৩.বিশেষ টিপস  

  • গরম পানিতে ভিজালে কিসমিসের পুষ্টিগুণ দ্রুত মুক্ত হয়।  
  • মধু বা দারুচিনির গুঁড়া মিশিয়ে খেতে পারেন।  

সতর্কতা  

কিসমিস খাওয়ার সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ প্রত্যেকটা জিনিসেরই কিছু ভালো এবং খারাপ দিক থাকে। তাই অতিরিক্ত কিসমিস খাইলে আপনার শারীরিক কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন:

  • অতিরিক্ত কিসমিস খেলে ডায়রিয়া বা পেট ফাঁপা হতে পারে।  
  • ডায়াবেটিস রোগীদের অতিরিক্ত কিসমিস খাওয়া উচিত নয়। কারণ এটাতে অধিক পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি থাকে। তাই, ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো।
  • যাদের অ্যালার্জি আছে, তারা সতর্কতার সাথে খাবেন।  
  • অতিরিক্ত কিসমিস খাওয়ার ফলে ওজন বেড়ে যেতে পারে। তাই পরিনিত মাত্রায় খাওয়াই শ্রেয়।

উপসংহার  

আমরা অলরেডি কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়ার উপকারিতা, সাবধানতা এবং ভেজানোর নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি। আমরা এটাও জেনেছি, কিসমিস ভিজিয়ে খাওয়া একটি সহজ কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর এবং স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এটা শুধু শক্তি বাড়ায় না, বরং দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বল্পমেয়াদী বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষা দেয়। তাই যদি কোন ব্যক্তি নিয়মিত কিসমিস সকালে ভিজিয়ে খাওয়ার অভ্যাস করতে পারে, তাহলে পেতে পারে প্রাকৃতিকভাবে একটি সুস্থ জীবন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button