অতিরিক্ত বা বেশি ঘুমের সবথেকে ক্ষতিকর প্রভাব গুলো কি

বেশি ঘুমের ক্ষতিকর প্রভাব বা বেশি ঘুমালে কি হয়

শরীরকে সুস্থ রাখতে ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কিন্তু বেশি ঘুমও স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। ঘুমের অভাব যেমন মানুষকে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভোগায়, তেমনি অতিরিক্ত ঘুমও মহাক্ষতির কারণ হতে পারে আমাদের জন্য।

বিজ্ঞানের ভাষায় অতিরিক্ত ঘুমানোকে সাধারণত হ্যাপেরসোমনিয়া বা হ্যাপেরসাম্যলেন্স (Hypersomnia or Hypersomnolence) বলে। কেউ যদি ৯ ঘণ্টার বেশি ঘুমায় তবে তাকে ‘অতিরিক্ত ঘুম’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল স্লিপিং ফাউন্ডেশন সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের একটি গবেষণায় বলেছেন। ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী একজন মানুষের সুস্থ থাকার জন্য সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট।

অতিরিক্ত ঘুমানো সংক্রান্ত অনেক গবেষণায় প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৯ ঘন্টার বেশি ঘুমানোকে মানদন্ড হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। মার্কিন গবেষণা থেকে জানা গেছে, কম ঘুম ও অতিরিক্ত ঘুম উভয়ের ফলে হৃদরোগ, স্থূলতা, উদ্বেগ নানাবিধ সমস্যা দেখা দেয়।

আসলে আমরা অনেকেই জানি অতিরিক্ত ঘুম স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিক। কিন্তু বেশি ঘুমালে শারীরিক কি ধরনের ক্ষতি হয় এটা সম্পর্কে খুব বেশি অবগত নই। তাই আজ আমরা অতিরিক্ত ঘুমের কারণ এবং ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

বেশি ঘুমালে কি হয় বা অতিরিক্ত ঘুমের ক্ষতিকর প্রভাব কি

বেশি ঘুমালে কি হয়

1-মস্তিষ্ক দুর্বল হয়ে যায়

অতিরিক্ত ঘুম আপনার চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করে দিতে সাহায্য করে। ফলে কোনো কিছু মনে রাখতে না পারা, মাঝে মধ্যেই ভুলে যাওয়ার মত সমস্যা দেখা দেয়। সবচেয়ে বড় বিপত্তি হল মনোযোগের অভাব দেখা দেয়। যার ফলে পড়াশোনা হোক বা অফিস সব জায়গাতেই অসুবিধায় পড়তে হয়।

পাশাপাশি, যারা বেশি ঘুমায় তাদের আলঝাইমার রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। বেশি ঘুমালে মস্তিষ্কের বয়স বেড়ে যায়, আর এটা থেকে এই সমস্যা হয়। আপনার ঘুমের চাহিদা যত বেশি হবে, মস্তিষ্কের কাজ করার শক্তিও তত কমে যাবে। তাই মস্তিষ্ক ভালো রাখতে আদর্শ মাত্রার ঘুম খুবই জরুরী।

2-শারীরিক ওজন বৃদ্ধি পায়

অতিরিক্ত ঘুমের সঙ্গে অতিরিক্ত ওজন যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দীর্ঘ সময় ঘুমের ফলে মানসিক বিষণ্ণতা, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ও ওজন বাড়ার প্রবণতা বেড়ে যায় অনেকটাই।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক এলিজাবেথ ম্যাকডেভিট জানান, লম্বা সময় ঘুমের জন্য বিছানায় থাকতে হয় প্রয়োজনের চাইতে অনেক বেশি সময়। ফলে সারাদিনে যতটুকু ক্যালোরি বার্ন করা প্রয়োজন, তার চাইতে কম ক্যালোরি বার্ন হয়। আর বাড়তি ক্যালোরি সহজেই শরীরে জমে ফ্যাট তৈরি করে।

সাম্প্রতিক আরও একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে ৯ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমানো একজন মানুষের সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানো মানুষের চেয়ে ৬ বছরে ২১ শতাংশ ওজন বৃদ্ধি পায়। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে বেশি না ঘুমিয়ে আদর্শ মাত্রায় ঘুম এবং ব্যায়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলুন।

3-আয়ু কমে যায়

ভয়ানক হলেও এটাই সত্যি। অত্যধিক ঘুম আয়ু কমিয়ে দেয়। রোগ না হলেও যারা বেশি ঘুমান তারা অন্যদের তুলনায় তাড়াতাড়ি মারা যান। পাশাপাশি, যারা বেশি ঘুমান তাদের মুড সুইং খুব বেশি হয়। হতাশার পরিমাণও তাদের বেশি হয়। তাই বেশিও না কমও না, দিনে সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমের অভ্যাস করুন।

4-ডায়াবেটিস বেড়ে যায়

বেশি ঘুমালে রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। যার ফলে টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। একটি কানাডীয় গবেষণায়, ২৭৬ জন মানুষের জীবন জাপনের ধরণের উপর ৬ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়।

সেখান দেখা গেছে, যাদের ঘুম আদর্শ সময়ের চেয়ে কম বা বেশি, তাদের শরীরের গ্লুকোজের অসাম্যতার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। যাদের ঘুম আদর্শ সময় মতো হয় না, তাদের ডায়াবেটিসের সম্ভাবনা থাকে ২০%।

আবার যদি নিয়মিতভাবে ঘুমের আদর্শ সময় মানা না হয়, তবে দ্বিতীয় শ্রেণীর ডায়াবেটিস হবার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। ২০১৩ সালের একটি গবেষণায় পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে, যে ব্যক্তিরা দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি ঘুমান, তাদের টাইপ-২ ডায়বেটিস হওয়ার সম্ভবনা বৃদ্ধি পায় অনেক বেশি এবং গ্লুকোজ টলারেন্সের ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া 7-9 ঘণ্টার বেশি ঘুম ডায়বেটিস সংক্রান্ত জটিলতা বৃদ্ধি করতেও সাহায্য করে অনেকটা।

5-হৃদ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়

বর্তমানে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ছে জ্যামিতিক হারে। আর অতিরিক্ত ঘুম হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর অন্যতম একটি কারণ। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার এর স্লিপ এন্ড এপিলেপ্সি বিভাগের ডিরেক্টর কার্ল বাতিলের মতে, অনেকেই কোন সমস্যা ছাড়াই প্রয়োজনের চাইতে বেশি সময় ঘুমান।

তিনি বলেন, অতিরিক্ত সময় ঘুমানোর পেছনে হৃদযন্ত্রের সমস্যা লুকায়িত থাকে। দীর্ঘ সময় যারা ঘুমান, তাদের মাঝে ৩৮ শতাংশ মানুষের হৃদযন্ত্র বড় থাকে। আবার ৪৬ শতাংশ মানুষের স্ট্রোকের সম্ভবনা বেশি থাকে।

অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা দিনে 8 ঘন্টার বেশি ঘুমায়, তাদের সাধারণের চেয়ে অ্যাজাইনায় (হৃদযন্ত্রে রক্তের প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে যে ব্যথা অনুভূত হয়) আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ থাকে।

পাশাপাশি, অন্যান্য হৃদরোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ১০% বেড়ে যায়।আবার, ৭১,০০০ মধ্যবয়স্ক নারীকে নিয়ে করা একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, যারা দিনে ৯-১১ ঘন্টা পর্যন্ত ঘুমায়, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৮% বেশি থাকে। তাই, অত্যাধিক ঘুমের অভ্যাস থাকলে আজ থেকেই ঘুমের পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করুন।

6-শারীরে ব্যথার সৃষ্টি হয়

ব্যথাভাবকে প্রশমিত করতে ও শরীরকে আরাম প্রদান করতে পরিমিত ঘুম খুবই প্রয়োজন। কিন্তু এই ঘুমের মাত্রা যখন বেড়ে যায়, তখন সেটা ব্যাক ফায়ার করে।অর্থাৎ, দীর্ঘ সময় ধরে শরীর কোনো নড়াচড়া না করলে, স্বাভাবিকভাবেই ব্যথার সৃষ্টি হয়। যা থেকে শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথাভাব দেখা দেয় বলে জানান কার্ল বাযিল।

এক্ষেত্রে পিঠে ব্যথা, কোমর ব্যথা, পেশির ব্যথা, ইত্যাদি প্রবলভাবে লক্ষ্য করা যায়। লম্বা সময় ধরে সঠিক নিয়মে না শুয়ে থাকা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। অনেক সময় অতিরিক্ত ঘুমানোর জন্য মাথাব্যথারও সৃষ্টি হয়। একে ওইকেন্ড হেডএক বলে। আবার, অতিরিক্ত ঘুম মাইগ্রেনের সমস্যাও বাড়ায়।

7-গর্ভধারণে সমস্যা হয়

অতিরিক্ত ঘুম গর্ভধারণে সমস্যা তৈরি করে। কোরিয়ান একটি রিসার্চ দল ২০১৩ সালে ৬৫০ জন নারীর উপর একটি পরীক্ষা করেন। তারা দেখেছেন, যারা দৈনিক নিয়ম মেনে ৭-৮ ঘন্টা ঘুমান তাদের গর্ভধারণের জটিলতা খুব কম হয়।

পাশাপাশি, তাদের মাসিক সঠিক সময়ে নিয়মিত হয়। অন্যদিকে যাদের ঘুমের সময় প্রয়োজনের চাইতে বেশি, তাদের ইনফার্টিলিটির সমস্যা তথা গর্ভধারণে জটিলতা দেখা দেয়।

8-মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পায়

অনেকেই হয়তো জানেন না যে অতিরিক্ত ঘুমের ফলে মানসিক বিষণ্ণতা দেখা দেয়। যদিও বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষের মাঝে ইনসমনিয়ার প্রভাব দেখা যায় বেশি। তবে ১৫ শতাংশ মানুষের মাঝে বেশি ঘুমানোর ফলে বিষণ্ণতার সমস্যাটি দেখা দেয়।

ঘুমের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা ও গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ১০ ঘন্টা ঘুমের ফলেই মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। এছাড়া জন হপকিন্স মেডিকেল স্কুলের ভিন্ন একটি গবেষণার তথ্য মতে, অতিরিক্ত সময় ঘুমানোর ফলে শরীরের ঘুমের সুনির্দিষ্ট সাইকেল নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলেই মূলত বিষণ্ণতা দেখা দেয়।

9-মাথাব্যথা বৃদ্ধি পায়

দীর্ঘ সময় ঘুমানোর ফলে অনেকেরই মাথাব্যথা দেখা দেয়। যেখানে বেশী সময় ঘুম মানে বেশি সময় বিশ্রাম, সেখানে মাথাব্যথা দেখা দেওয়াটা একটু অবাক হবার মতো, তাই-না? তবে অনেকেই দীর্ঘ ঘুমের পর ঘুম থেকে উঠে মাথাব্যথা বা মাথা ঘোরার মতো সমস্যায় ভুগে থাকেন।

এমনটা হওয়ার কারণ হিসেবে এলিজাবেথ জানান, দীর্ঘ সময় ঘুমের কারনে শরীর সঠিক সময়ে পানি ও অন্যান্য খাবার পায় না। শরীরে পুষ্টি ও চিনির অভাব এবং পানিস্বল্পতার ফলে মাথাব্যথা শুরু হয়।

অতিরিক্ত ঘুমের কারন কি

অতিরিক্ত ঘুমের কারন কি?

  • ১) যে সমস্ত মায়েদের আয়রনের অভাব আছে তাদের ঘুম বেশি হয়।
  • ২) যেসব মানুষ রাতের বেলায় ঘুমাতে পারেন না তাদের দিনের বেলায় অনেকাংশে অনেক ঘুমাতে দেখা যায়।
  • ৩) যাদের ওজন বেশি তাদের ঘুম বেশি হয়।
  • ৪) দীর্ঘমেয়াদী অবসন্নতায় আক্রান্ত রোগীরা অতিরিক্ত ঘুমায়।
  • ৫) পারকিনসন্স, এনকেফালাইটিস, এলজেইমার্স, হাইড্রোসেফালাস-এই রোগের রোগীরা বেশি ঘুমায়।
  • ৬) ফাইব্রোমায়েলজিইয়ার রোগীরা অতিরিক্ত ঘুমায়।
  • ৭) অনেক ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে রোগীরা অনেকক্ষণ ঘুমায়।
  • ৮) এলকোহল সেবনের কারণে অতিরিক্ত ঘুম হয়। এছাড়াও মাদকজাত দ্রব্য সেবন করলে কিংবা হীনম্মন্যতায় ভুগলেও অতিরিক্ত ঘুমানোর অভ্যাস দেখা যায়।
অতিরক্ত ঘুমের ক্ষতিকর প্রভাব

সামারী

খাবার যতটা দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ঠিক তেমনি ঘুমও দেহের কার্যক্রম ঠিকভাবে বজায় রাখার জন্য অতীব জরুরি। কিন্তু মনে রাখা উচিত, অতিরিক্ত ঘুমের ক্ষতিকর প্রভাব তার থেকেও বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি ঘুমানোর কারণে কর্মদক্ষতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি বিষণ্নতাও জেঁকে বসে।

তাই সুস্থ থাকতে পরিমিত ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ঘুমানোর আদর্শ সময়সীমা ৭-৮ ঘন্টা। এখানে প্রাপ্তবয়স্ক বলতে বোঝানো হয়েছে, যাদের বয়স ১৮-৬৪ বছর। অর্থাৎ অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে ঘুমের এই আদর্শ সময়সীমা প্রযোজ্য না। তাই সুস্থ থাকতে আজ থেকেই পরিমিত ঘুমের অভ্যাস গড়ে তুলুন।

Leave a Comment