ধূমপানের খুব গুরুত্বপূর্ণ 12টি ক্ষতিকর প্রভাব

ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব

ধূমপান বলতে তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে নিঃশ্বাসের সাথে, তার ধোঁয়া ফুসফুসে প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াকে বুঝায়। অন্যভাবে বলা যায়, তামাক পোড়ানোর মাধ্যমে উৎপাদিত ধোঁয়া নিয়মিত ব্যবহারের ফলে মানব স্বাস্থ্যের উপর এর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তাকে ধূমপান বলে।

সাধারণত যেকোনো দ্রব্যের পোড়ানো ধোঁয়া নিঃশ্বাসের সাথে ফুসফুসে প্রবেশ করলে তাকে ধূমপান বলা গেলেও, মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া ফুসফুসে প্রবেশ করানোর প্রক্রিয়াকেই ধূমপান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ধূমপান পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত মারাত্মক একটি নেশা। আবার, অনেকের কাছে এটি ফ্যাশন হিসেবেও গণ্য। যে কোনোভাবে, যেকোনো ধূমপানই যে স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ একথা আজ শুধু চিকিৎসক বা চিকিৎসা বিজ্ঞানেরই কথা নয়। একথা আজ আমরা সবাই জানি।

তারপরও আজকের পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ ধূমপান করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ধূমপান প্রায় আত্মহত্যার সমান।

তাই আজ আমরা জানবো:

  • মানব শরীরে ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব কি?
  • পরোক্ষ ধূমপান কি?
  • এছাড়াও, পরোক্ষ ধূমপানের কোন ক্ষতিকর প্রভাব আছে কি-নাই?

চলুন তাহলে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি-

ধূমপানের ক্ষতিকর দিক বা প্রভাব

ধূমপানের ক্ষতি

তামাকের মধ্যে নিকোটিন নামক এক প্রকার বিষাক্ত পদার্থ থাকে, যা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এছাড়াও অসংখ্য বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে এই তামাকের মধ্যে। যারা ধূমপান করে তাদের আঙ্গুলের ফাঁকে, ঠোঁটে, জিভের ডগায় এবং দাঁতের মাড়িতে এক ধরনের কালচে দাগ দেখা যায়। এটা নিকোটনের প্রভাব।

ধূমপানের ফলে ধোয়ার সাথে এই নিকোটিন মানুষের শ্বাসনালী দিয়ে প্রথমে ফুসফুসে প্রবেশ করে। তারপর এটা রক্তের সাথে মিশে সারাদেহে ছড়িয়ে পড়ে। আবার, এর কিছুঅংশ নিকোটিন বের হয়ে আসা ধোয়ার সাথে বাইরে বেরিয়ে আসে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে প্রতিবছর সারাবিশ্বে প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ তামাকের ক্ষতিকর প্রভাবে মারা যায়। যার মধ্যে প্রায় ৬ লক্ষ মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের স্বীকার।

বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আজ আমরা জানতে পেরেছি ধুমপান করার ফলে অনেক রোগ হয়। যেমন, ফুসফুসের ক্যানসার. ব্রনকাটিস, আলসার, ঠোট কালো হয়ে যায়, যৌন শক্তি কমে যায়, স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এছাড়াও ধূমপানের আরো অনেক ক্ষতিকর দিক বা প্রভাব রয়েছে। সেগুলো নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে –

#1-চোখের অন্ধত্ব সৃষ্টি করতে পারে ধূমপান

চোখের গুরুত্ব কতটা তা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। অন্ধত্ব চলে এলে সারা পৃথিবীই যেন অন্ধকার হয়ে পড়ে। নিজের প্রিয়তম মানুষদেরও দেখতে পাওয়া যায় না। আর এই অন্ধত্ব আসতে পারে অতিরিক্ত ধূমপান থেকেও।

মার্কিন আই স্পেশালিস্ট অয়ামি রডরিগেস এমনই জানিয়েছেন। ধূমপানের কারণে, চোখে ছানি পড়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। যাঁরা দিনে ১৫ বার ধূমপান করেন তাঁদের চোখে ছানি পড়ার সম্ভাবনা তিন গুণ বেড়ে যায়।

সিগারেটে বেশ কিছু নিউরোটক্সিক কেমিক্যাল থাকে। এই কেমিক্যাল চোখের কালার মিশনকে খারাপ করে দেই। ফলে লাল-সবুজ ও নীল-হলুদ এই রং-গুলি দেখার ক্ষেত্রেও বেশ কিছু পরিবর্তন আসতে থাকে। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ১ কোটি। এমনকী চোখে ছানির চেয়ে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি।

চিকিৎসকরা জানান, 5-10 বছর বা তার বেশি সময় ধরে যারা ধূমপান করছেন বা তামাকজাত দ্রব্য গ্রহন করছেন, তাদের চোখের স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে অন্ধত্ব পর্যন্ত হতে পারে।আবার, ধূমপান ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করে। যা চোখের রক্তনালীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যেতে পারে।

পাশাপাশি, ধূমপান প্রাইমারি ওপেন অ্যাঙ্গেল গ্লুকোমার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। যেটা চোখকে অন্ধ করে দিতে পারে। চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলেছেন, ধূমপানের কারণে শরীরে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট কমে যায়। যার ফলে চোখের লেন্স প্রোটিন নষ্ট হয়ে যায়। এই জন্য চোখের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।

ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, এখনো পর্যন্ত দিল্লির এইমস হাসপাতালে যতজন দৃষ্টিশক্তিহীন রোগী এসেছেন, তাদের পাঁচ শতাংশ তামাকের কারণেই দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। তাই চোখ ভালো রাখতে আমাদের অবশ্যই ধূমপান ত্যাগ করা উচিত।

#2-মাথায় টাক পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়

ধূমপান চুলের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ধূমপানের প্রভাবে চুলপড়তে শুরু করে। ধূমপান হেয়ার ফলিকল বা চুলের গোড়ায় ক্ষতি করে। এ কারণে চুল পাতলা হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, চুল সহজে ভেঙে যায়। এমনকি চুল পেকেও যেতে পারে। যারা ধূমপান করেন তারা একটা সময়ে পুরোপুরি টাক হয়ে যেতে পারে।

চুলের গোড়ায় অতি সূক্ষ সূক্ষ রক্তনালী থাকে। ধুমপান করলে এই সূক্ষ রক্তনালীগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আর চুলের পুষ্টি আসে রক্তের মাধ্যমে, তাই এই রক্তনালীগুলো বন্ধ হয়ে গেলে চুল পড়ে যেতে‌ শুরু করে। শুধু তাই নয়, ধুমপান বড় বড় রক্তনালীকেও বন্ধ করে দিতে সাহায্য করে।

অন্য এক গবেষণায় জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে যারা ধূমপান করছেন তাঁদের চুল অন্যদের তুলনায় অনেক পাতলা। কারণ সিগারেট চুলের ডিএনএ গুলোকে নষ্ট করে দেয়। ফলে চুল পড়ে যায়।আবার, ধূমপান করলে চুল গন্ধ হয়ে যায়, শুষ্ক হয়ে যায় এবং চুল ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই চুলের যত্নে আমাদের অবশ্যই ধূমপান ত্যাগ করতে হবে।

#3-ত্বক অনুজ্জ্বল ও ফ্যাকাশে হয়ে যায়

ধূমপান করলে ত্বক বিবর্ণ, অনুজ্জ্বল ও ফ্যাকাশে হয়ে যায়।পাশাপাশি বয়সের বিভিন্ন ছাপ দেখা যায় চেহারায়। চোখ ও ঠোঁটের পাশে দেখা যায় ছোট ছোট রিংকেল। এছাড়া ধূমপানের কারণে ত্বক অক্সিজেন ও পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। যা ত্বকের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে।

ত্বককে উজ্জ্বল ও সুরক্ষিত রাখার জন্য ভিটামিন সি একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। আর ধূমপানের কারণে শরীরে এই ভিটামিন সি-এর অভাব দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীদের তুলনায় কম ঘুমায়। ঘুম কম হবার কারণে ত্বকের অনেক সমস্যাই হতে পারে। তার মাঝে সবচেয়ে স্পষ্ট হলো চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল দেখা দেয়।

অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে হিমোগ্লোবিন বেশি পরিমাণে অক্সিজেন বহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। যে কারণে শরীরের ক্ষত সারতেও অধিক সময় লাগে।আবার, ধূমপান করলে শরীরে কার্বন মনোক্সাইডের প্রবেশ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে ত্বকের অক্সিজেনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।

পাশাপাশি নিকোটিনের জন্য শরীরে ঠিকভাবে রক্ত চলাচল হয় না। এর ফলে ত্বকের জেল্লা হারাতে শুরু করে। পাশাপাশি, ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। এছাড়াও, অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে আপনাকে বয়সের তুলনায় বেশি বয়স্ক দেখাতে পারে। কারণ ধূমপান বলিরেখা তৈরির ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন প্রভাব রাখে।

#4-রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে

সঠিক রক্ত সঞ্চালন শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন, পুষ্টি ও রক্ত শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রেরণে সাহায্য করে রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা। যখন দেহে এই রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা হয়, তখন দেহের কোষগুলি প্রয়জনীয় অক্সিজেন এবং পুষ্টি পেতে সক্ষম হয় না।

ফলে, শরীরের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টির চাহিদার ঘাটতি পড়ে। আর সিগারেট, বিড়ি, হুকো ইত্যাদিতে থাকা তামাক থেকে উৎপন্ন নিকোটিন রক্ত চলাচলে বাধাগ্রস্ত করে। শুধু তাই নয়, অনেক সময় অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে রক্ত জমাট বাঁধতেও শুরু করে।

এছাড়া, তামাকের রাসায়নিক পদার্থগুলো রক্তনালীর পর্দা নষ্ট করে দেয়। পাশাপাশি, রক্ত চলাচলের সময় লিপিড বা চর্বির মাত্রার ওপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এটা এথেরোমারঝুঁকি বাড়ায়। যেটাকে ধমনী শক্ত হয়ে যাওয়া রোগ বলা হয়।

এটা হৃদরোগ, স্ট্রোক, পায়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া, ধমনী ফুলে যাওয়া ও ধমনী ফেটে রক্ত বের হওয়া বা এনিউরিজমের জন্য প্রধান ভাবে দায়ী। এইসব রোগ যে কোনো ধূমপায়ীদের জন্য সবচেয়ে পরিচিত।

#5-স্ট্রেচ মার্ক দেখা দেয়

ওজন দ্রুত বাড়া বা কমার কারণে যে কারোই শরীরে স্ট্রেচ মার্ক দেখা দিতে পারে। কিন্তু ধূমপান করলে স্ট্রেচ মার্ক দেখা দেওয়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। সিগারেটে উপস্থিত নিকোটিন শরীরের ফাইবার এবং সংযুক্ত টিস্যুগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে ত্বক তার নিজস্ব শক্তি ও নমনীয়তা হারায়। এই কারণে শরীরের বিভিন্ন অংশে যেমন: পেট, হাত, উরু প্রভৃতি অংশে স্ট্রেচ মার্কস প্রকট হয়ে ওঠে।

আবার, ধূমপানের কারণে খুব কম বয়সেই মুখের আশেপাশে, কপালে, চোখের পাশে, গলায় ও বুকের ত্বকে বলিরেখা পড়তে পারে। আপনার আসল বয়সের তুলনায় আপনাকে বয়স্ক দেখাতে পারে।

পাশাপাশি, বয়স্ক মানুষদের ত্বকে যেমন ফোঁটা ফোঁটা দাগ পড়ে, তেমনি দাগ পড়তে পারে ধূমপায়ীদের ত্বকে। এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যারা ধূমপান করেন না তাদের থেকে, যারা ধূমপান করেন তাদের চেহারার বয়স ১.৪ গুন বেশি হারে বাড়ে।

#6-ক্যান্সারের বড় কারণ ধূমপান

বর্তমানে বিশ্বে প্রতিদিন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে একুশ হাজার মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, 2008 সালে 76 লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর ধূমপান এই ক্যান্সারের অন্যতম একটি বড়ো কারণ।

ধূমপায়ীদের মুখে, নাকে, গলায়, স্বরযন্ত্রে, খাদ্যনালীত (অন্ননালী), অগ্ন্যাশয়ে, মূত্রাশয়ে, গর্ভে (জরায়ু), রক্তে (লিউকেমিয়া) এবং কিডনিতে ক্যান্সার খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। সিগারেটের ধোঁয়া থেকে প্রায় পাঁচ হাজার রাসায়নিক দ্রব্য সনাক্ত করা গেছে এ পর্যন্ত। এগুলোর মধ্যে কমপক্ষে 70 টি সরাসরি ক্যান্সারের জন্য দায়ী। আর এরমধ্যে নিকোটিন সব থেকে বেশি পরিচিত।

যেসব ক্যান্সারের জন্য মানুষ সবথেকে বেশি মারা যায়, তার মধ্যে প্রথম হলো ফুসফুসের ক্যান্সার। নারী ও পুরুষ উভায়ের ক্ষেত্রেই মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো ফুসফুসের ক্যান্সার। এই জন্য এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

তবে যখন এই ক্যান্সার ধরা পড়ে, তখন 70 ভাগ ক্যান্সারই মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তাই আর অস্ত্রোপচারের সুযোগ থাকে না। তবে এই রোগটি প্রতিরোধযোগ্য। একটু সচেতনতাই পারে এই রোগ থেকে মুক্তি দিতে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, ফুসফুসের ক্যান্সার 85 পার্সেন্টই ধুমপানের কারনে হয়। 1950-2000 সালব্যাপী এক গবেষণায় বলা হয়েছে, উন্নত বিশ্বে ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মধ্যে 90% পুরুষ এবং 70% নারী ধুমপায়ী।

আবার, একটি মার্কিন গবেষণায় দেখা গেছে, ঐ দেশের 90% মানুষের ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য দায়ী ধূমপানের অভ্যাস। সিগারেটে থাকা হাজার ধরণের রাসায়নিক ফুসফুসের কোষের ডিএনএকে পরিবর্তন করে দেয়। ফলে ধীরে ধীরে ওই কোষগুলো সুস্থ থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

এছাড়াও ধুমপায়ী মহিলাদের স্তনক্যান্সার, আর সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের হারও অনেক বেশি।ধূমপান করলে ক্যান্সারে আক্রান্তের সম্ভাবনা বাড়ে সে কথা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এই প্রক্রিয়াটি খুব ধীর গতিতে হয়ে থাকে। যে কারণে ধূমপায়ীরা বুঝতেই পারেন না যে, ধূমপান করার অভ্যাসটি তাঁকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই ক্যান্সার থেকে মুক্তি পেতে আমাদের অবশ্যই ধূমপান ত্যাগ করা উচিত।

#7-হৃদ রোগ সৃষ্টি করে

হৃদরোগ বলতে সাধারনভাবে হৃৎপিন্ড, রক্তবাহী ধমনী, শিরা, মস্তিষ্ক ও বৃক্ক সম্পর্কিত রোগকে বোঝায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরও বাড়তে থাকে। আর এই হৃদরোগের সাথে ধূমপানের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা কখনো ধূমপান করেনি তাদের থেকে ধূমপায়ীদের হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণ। তাই বলা হয়, ধূমপানের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ক্যান্সার নয়, বরঞ্চ হৃদরোগ। ধূমপানের ফলে মৃত্যুর ৪৮ শতাংশই হয় হৃদরোগ থেকে।

দিনে অন্তত ২০টি সিগারেট খান, এরকম ১০০ ধূমপায়ীর ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, তাদের সাত জনই হয় হার্ট অ্যাটাক, না হয় স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। অধ্যাপক হ্যাকশ’র মতে, ক্যান্সারের চেয়ে হৃদরোগের বা স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ধূমপান অনেক বেশি ঝুঁকি তৈরি করে।

ধূমপানের কারণে রক্তের ধমনীতে প্লেক নামক একধরণের চর্বি জাতীয় পর্দা জমার প্রবণতা দেখা যায়। এই রোগের নাম অ্যাথেরোসক্লেরোসিস। এছাড়াও ধূমপানের কারণে করোনারি হার্ট ডিজিজের আশঙ্কাও বেড়ে যায়। ধূমপানের কারণে রক্ত জমাট বাঁধারও সম্ভাবনা থাকে। এই সবকিছুই করোনারি হার্টের অসুখ।

আবার, সিগারেটের নিকোটিন শরীরে অ্যাড্রেনালিন উৎপাদনে সহায়তা করে। ফলে হাটের স্পন্দন দ্রুত হয় এবং ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যায়। এর ফলে হার্টকে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। যেটা হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।

#8-গর্ভবতী কালীন ঝুঁকি বৃদ্ধি করে ধূমপান

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন মহিলাদের মধ্যেও তামাক সেবনের মাত্রা ক্রমশই বাড়ছে। প্রতি 100 জন এশিয়ার মধ্যে প্রায় শতকরা 44 ভাগ পুরুষ ও 4 ভাগ মহিলা সিগারেট খান। ইউরোপে নারীদের সিগারেট খাওয়ার হার বেশি, প্রায় শতকরা 46 ভাগ পুরুষ ও 26 ভাগ মহিলা।

আমেরিকায় এটি প্রায় 35 ও 22 ভাগ। কিন্তু পশ্চিম মহাসাগরীয় অঞ্চলে সিগারেট একটি মহামারির আকার ধারণ করেছে। প্রায় 60 ভাগ পুরুষ ও 8 ভাগ নারী সিগারেটে আসক্ত।

গর্ভাবস্থায় ধূমপান করলে শুধু গর্ভবতী মায়েরই ক্ষতি হয় না, তার হবু সন্তানেরও নানা রকম ক্ষতি হয়। ধূমপানের কারণে গর্ভবতী মায়েদের উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। এর ফলে গর্ভবতী মায়ের প্রিক্লামসিয়া বা এক্লাম্পসিয়ার মতো প্রাণঘাতী সমস্যা দেখা দিতে পারে।

গর্ভাবস্থায় ধূমপান করলে গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পাশাপাশি, নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই সন্তানের জন্ম হতে পারে কিংবা অনেক সময় গর্ভের বাচ্চা অপরিণতও থেকে যেতে পারে। গভর্স্থ সন্তানের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

আবার, সন্তান জন্ম নিলে সেই সন্তান বিকলাঙ্গও হতে পারে। পাশাপাশি, অন্যান্য রোগেরও শিকার হতে পারে। এছাড়াও নারীরা ধূমপান করলে স্তন এবং গর্ভাশয়ের ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।

#9-শিশুর ক্ষতি

যারা ধূমপায়ী ও মাদকাসক্ত তারা শুধু নিজেদেরই ক্ষতি করছে না, আমাদের সমাজেরও ভবিষ্যৎ নষ্ট করছে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। গর্ভের সন্তানও এই নিরাপত্তাঝুঁকিতে পড়ে।

পরোক্ষ ধূমপানের কারণে শিশুরা হার্ট অ্যাটাক, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সিগারেটের ধোঁয়ায় শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হয়।

ধূমপানের বিরুদ্ধে জোরালো অভিযান পরিচালনা না করলে তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংসের কবল থেকে রক্ষা করা যাবে না। নেশাগ্রস্ত ধূমপায়ীরা কাউকে তোয়াক্কা করছে না। তাই নৈতিক মূল্যবোধ দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

#10-দাঁত নষ্ট হয়ে যায়

মুখের স্বাস্থ্যকর অবস্থা, সজিব নিঃশ্বাস, সুন্দর মুখশ্রী ও ঝকঝকে দাঁত মানুষের ব্যক্তিত্বকে আরও সমৃদ্ধ করে। সেই সাথে তাদের সঙ্গে সকল মানুষের সম্পর্কও দৃঢ় করতে সাহায্য করে। কিন্তু ধূমপান আপনার দাঁতকে নষ্ট করে দিতে পারে। বিজ্ঞানের দীর্ঘদিনের গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে মাড়ির রোগের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে তামাক বা সিগারেট।

সকল বয়সের ধূমপায়ীদের মাড়ির বিভিন্ন রোগ অধূমপায়ীদের তুলনায় অনেক মাত্রায় বেশি। যারা ধূমপান করেন তাদের দাঁতের মাড়ির সংলগ্ন স্থানে অধূমপায়ীদের চাইতে বেশি ক্যালকুলাস বা খাদ্য আবরণ জমাতে দেখা গেছে। এটা দাঁতের জন্য খুব ক্ষতিকর।

আবার, ধূমপায়ীদের মুখের দুর্গন্ধ বিশেষত ঐ ধরনের তামাকজাত দ্রব্যের থেকেই সৃষ্টি হয়। ফলে ধূমপায়ীর শ্বাস-প্রশ্বাসে ঐ বিশেষ ব্রান্ড বা সিগারেট-এর গন্ধ সনাক্ত করা যায়। এছাড়াও মাড়ির রোগের অন্যান্য যেসব কারণ রয়েছে তা হচ্ছে মুখের অস্বাস্থ্যকর অবস্থা ও অন্যান্য রোগের উপস্থিতি যেমন ডায়াবেটিস। আবার তামাক চিবানো থেকে মুখগহ্বরের ক্যান্সারও হতে পারে।

#11-শুক্রাণুর উর্বরতা হ্রাস করে

2010 সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপান পুরুষের শুক্রাণুর গুণগত-মানকে ক্ষতি করে এবং মহিলাদের মধ্যে ইস্ট্রোজেন উৎপাদন হ্রাস করে। বর্তমানে তরুণদের মধ্যে বন্ধ্যত্বের হার বৃদ্ধির পিছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে সিগারেট। এটি গর্ভপাত অঙ্গের ক্ষতি বা ডিম্ব স্ফোটন সমস্যার সম্ভাবনাও বাড়িয়ে তোলে।

উক্ত গবেষণায় আরও দেখা গেছে প্রতিদিন সর্বোচ্চ 20 টি সিগারেট খাওয়া পুরুষের শুক্রাণুর ক্ষমতা 39% কমে যায়। প্রতিদিন মাত্র 2টা থেকে 1টা সিগারেট খাওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখা গিয়েছে। সুতরাং, একথা স্পষ্ট আপনি যদি সুখী দাম্পত্য জীবন চান, তাহলে আজকেই ধূমপান ত্যাগ করুন।

#12-ধূমপানের অন্যান্য ক্ষতি কর প্রভাব

উপরোক্ত ক্ষতি ছাড়াও ধূমপানের আরো অন্যান্য অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। নিয়মিত ধূমপান আপনার স্ট্যামিনা অনেক কমিয়ে দেয়। একটু কাজের চাপ বাড়লেই হাঁপিয়ে ওঠে শরীর। প্রতিদিনের অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস শরীরকে ক্রমশ দুর্বল করে দেয়। রোগ সংক্রমণের সম্ভাবনাও বাড়ে।

ধূমপান শুধুমাত্র স্ট্রোক‌ বা ক্যান্সারের কারণ নয়। এটা আপনার যৌন জীবনের আনন্দকে কেড়ে নিয়ে আপনাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিতে পারে।এমনটাই বলছে চীনের একটি গবেষণা দল।নিয়মিত ধূমপানের কারণে শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যাথা, সর্দি-কাশির মতো দৈনন্দিন রোগ দেখা দিতে পারে।

আবার, ধূমপানের কারণে হতে পারে এমফিসেমা। যে রোগের কারণে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা আংশিকভাবে নষ্টই হয়ে যায়। পাশাপাশি, ধূমপানের কারণে স্বাদ ও গন্ধ নেয়ার ক্ষমতা হারিয়ে যায়।

ধূমপান যে শুধুমাত্র শারীরিক ক্ষতির কারণ তা নয় বরং এর আরো অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। ধূমপানের ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এই ধোঁয়া পরিবেশকে দূষিত করে।

ধোঁয়ার দুর্গন্ধ অন্যদের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়। ধূমপানের ফলে মানুষ আর্থিকভাবেও অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জন্য আমাদের অবশ্যই ধূমপান বর্জন করা উচিত।

পরোক্ষ ধূমপান

পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব

ধূমপানের সময় ধোঁয়ার যে অংশ চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনৈচ্ছিকভাবে মানুষের ফুসফুসে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে তাকে পরোক্ষ ধূমপান বলে। অনেকের ধারণা প্রত্যক্ষ ধূমপান ক্ষতিকর। পরোক্ষ ধূমপান তেমন ক্ষতি করে না। আসলে এই ধারণা সত্য নয়।

প্রত্যক্ষ ধূমপানের মত পরোক্ষ ধূমপানও অনেক ক্ষতি কর। এই বিষয়টি সবাইকে বুঝতে হবে।প্রত্যেক্ষ ধূমপানে যেমন সমস্যা হয় তেমনিভাবে পরোক্ষ ধূমপানের ফলেও ফুসফুসের ক্যান্সার, হৃদরোগ, শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যা, স্ট্রোক, প্রজনন সমস্যা হতে পারে। অর্থাৎ একজনের কুকর্মের ফল আরেক জনকে বহন করতে হয়।

যিনি বা যাঁরা পেশাদার ধূমপায়ীদের সঙ্গে বসবাস করেন, তাঁদের হৃদরোগ এবং ফুসফুস ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা সাধারণ মানুষের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি থাকে। আবার, হৃৎপিণ্ডের ক্ষতিতে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব অনেক বেশি। টানা ৩০ মিনিট ধূমপানের ধোয়া গ্রহণ করলে হৃৎপিণ্ডের মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ্

শিশুদের বেলায় এই ক্ষতি আরো মারাত্মক। শিশুদের বাড়ন্ত শরীরে পরোক্ষ ধূমপান খুবই খারাপ প্রভাব ফেলে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে বছরে প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়।

এছাড়াও গর্ভবতী নারী এবং তাদের গর্ভের শিশুটিও মারাত্নক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকে পরোক্ষ ধূমপানের ফলে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে গর্ভস্থ শিশুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় গর্ভের প্রথম এবং শেষ তিন মাসে।

ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব

সামারি

সিগারেটকে এ যুগের ফ্যাশন বলা হয়। সিগারেট খেলে স্মার্ট, আর না খেলে আন-স্মার্ট, এমনটাই ভাবে আজকাল অনেকেই। বর্তমানে ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবাই সিগারেট খাচ্ছে। আমরা যা ভেবেই সিগারেট খাই না কেন, এটা কিন্তু জানি যে সিগারেট শরীরের জন্যে খুবই ক্ষতিকর।

সিগারেটের প্যাকেটে মধ্যে লেখা থাকে ধুমপান করলে মৃত্যু হয়। ধুমপান করলে হার্ট এটাক হয়। ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তারপরও আমরা সিগারেট খাই। গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিবছর প্রায় প্রায় ৫.৫ ট্রিলিয়ন সিগারেট তৈরি করা হয়।

আর প্রায় ১.১ বিলিয়ন মানুষ এই সিগারেট খায়। সিগারেট কাউকে একদিনে ধ্বংস করে দেয় না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে এর কুফল দেখা দিতে থাকে।

তাই আমাদের উচিত ধীরে ধীরে ধূমপান কমিয়ে আনা এবং সর্বশেষ ধুমপান ত্যাগ করা। নিজের কথা, নিজের পরিবারে কথা, সর্বোপরি নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমাদের ধুমপাম বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।

হঠাৎ করেই ধূমপান ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে সাকসেস পাওয়া সম্ভব নয়। তাই ধীরে ধীরে নিজের কল্যাণেই সিগারেট ছেড়ে বিশুদ্ধ খাবারের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে হবে।

(ধূমপান ত্যাগ করার বিজ্ঞানসম্মত কিছু উপায় এবং কৌশল সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন ) তাহলেই ধূমপান ত্যাগ করা সম্ভব হবে। তাই আর দেরি নয়, আজ থেকেই ধূমপান ত্যাগ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। আপনার প্রতি অনেক শুভকামনা রইল।

Leave a Comment