Others

দই খাওয়ার খুব গুরুত্বপূর্ণ ৯টি স্বাস্থ্য উপকারিতা

দই খাওয়ার উপকারিতা

পৃথিবীতে এমন অনেক খাবার রয়েছে যেগুলো আমরা প্রতিনিয়ত খেয়ে থাকি, কিন্তু এটার উপকারিতা সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত নয়। তেমনি একটি খাবার হলো দই। দই হল এক প্রকার দুগ্ধজাত খাদ্য যেটা দুধের ব্যাক্টেরিয়া গাঁজন থেকে তৈরি করা হয়।

আরো ভালো ভাবে বলা যায়, দুধের ল্যাক্টোজের গাঁজনের ফলে ল্যাক্টিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয় যেটা দুধকে দইয়ে রূপান্তরিত করে এবং একটি ভিন্ন রকম স্বাদ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গন্ধ প্রদান করে থাকে।

কে, কোথায় এবং কবে এই দই আবিষ্কার করেছিলেন এখনো পর্যন্ত এটার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হয়,4500 বছর আগে থেকে মানুষ এই দই তৈরি করছে এবং খেয়ে আসছে। আর বর্তমানে সারা পৃথিবীতে এটি একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু খাবার হিসাবে খুবই পরিচিত।

দইয়ে সাধারণত ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, রাইবোফ্ল্যাভিন, ভিটামিন বি৬ এবং ভিটামিন বি১২ বিদ্যমান থাকে। এছাড়াও, প্রতি ১০০ গ্রাম দইয়ে
শর্করা থাকে ৪.৭ গ্রাম, শক্তি থাকে ২৫৭ ক্যালরি, প্রোটিন থাকে ৩.৫ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১২১ মিলিগ্রাম, সুসিক্ত স্নেহ পদার্থ থাকে ২.১ গ্রাম, চিনি থাকে ৪.৭ গ্রাম, স্নেহ পদার্থ থাকে ৩.৩ গ্রাম, এবং অন্যান্য ভিটামিনসমূহ থাকে ০.১৪ মিলিগ্রাম।

যেহেতু দই একটি পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু খাবার হিসাবে খুবই পরিচিত, তাই আজ আমরা দুইয়ের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব।

দই খাওয়ার উপকারিতা

#1-রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হলো মানবদেহের নিজস্ব একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যেটার কাজ হলো শারীরিক বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আর দই শরীরের এই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

গবেষণায় দেখা গেছে, দইয়ে অবস্থিত প্রোবায়োটিক গুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে খুবই কার্যকরী। পাশাপাশি, এই প্রবায়োটিক গুলো ঠান্ডা, সর্দি, জ্বর ইত্যাদির বিরুদ্ধেও প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
এছাড়া দই শরীরের সেত রক্ত কণিকার সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়, ফলে শরীরে জীবাণু সংক্রমণ হ্রাস পায়।

#2-হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে বেশ উপকারী

সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হজম শক্তি একটি অপরিহার্য বিষয়। হজম শক্তি যদি ভালো না হয় তাহলে পেটের বিভিন্ন রোগ সহ পুরো শরীর স্থবির হয়ে পড়তে পারে। তাই হজম শক্তি ভালো রাখতে নিয়মিত দই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞরা।

আমরা আগেই জেনেছি দই একটি প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে যেটার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পাশাপাশি দইয়ে বিভিন্ন উপকারী ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যেগুলো পেটের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে এবং হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

পাশাপাশি, ডায়রিয়া, কোষ্টকাঠিন্য, কোলনক্যান্সার ও অন্ত্রের সমস্যা দূর করতেও দইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও পেপটিক আলসার প্রতিরোধ করতেও দইয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

#3-উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে

হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে যখন রক্ত প্রবাহের চাপ অনেক বেশি থাকে তখন সেটাকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। আর দক্ষিন অস্ট্রেলিয়ার কিছু গবেষকরা জানিয়েছেন, দই এই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে খুবই কার্যকরী। একই তথ্য পাওয়া গেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাতেও।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা বলছেন, দৈনিক যতটুকু ক্যালরি প্রয়োজন তার ২% যদি দইয়ের মাধ্যমে পাওয়া যায় তাহলে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি 30 শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। তাদের মতে এই উপকারিতাটা পেতে তিনদিন পর পর ১৭০ গ্রাম দই খাওয়াই যথেষ্ট।

এছাড়াও, দইয়ে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে। আর এই উপাদানগুলো উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে খুবই সহায়ক। পাশাপাশি, দই শরীরের ভালো কোলেস্টরেল (এইচডিএল) বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ফলে হার্টের বিভিন্ন সমস্যা হ্রাস পায়।

#4-হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে 

হাড় হল শরীরের একটি কঠিন অঙ্গ। মানব দেহে হাড়ের গুরুত্ব অনেক। তাই হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বিশেষজ্ঞরা প্রতিদিন দই খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কারণ, দইয়ে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন ডি থাকে। এই তিনটি উপাদানই হাড় এবং দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি, অস্টিওআর্থ্রাইটিসের মত রোগ প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে।

#5-স্বাস্থ্যকর ও উজ্জ্বল ত্বক পেতে সাহায্য করে 

প্রাচীনকাল থেকেই রূপচর্চায় মানুষ দই ব্যবহার করে আসছে। কারণ দইয়ে অবস্থিত ল্যাকটিক অ্যাসিড, মিনারেল এবং জিঙ্ক শরীরের জন্য খুবই উপকারী একই সাথে ত্বক ফর্সা করতেও খুব কার্যকরি। 

পাশাপাশি, দই ত্বকের আর্দ্রতা রক্ষা করে এবং শুষ্ক ত্বক প্রাকৃতিকভাবে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। দইয়ের উপকারী ব্যাকটেরিয়া গুলো ত্বককে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং ভিটামিন ‘ডি’, ক্যালসিয়াম, ও প্রোটিন ত্বকের রং উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে।

দইয়ে অবস্থিত ইলেকট্রিক এসিড ত্বকের মৃত কোষ দূর করতে এবং ত্বক পরিষ্কার করতেও খুব কার্যকরী। এছাড়াও, ব্রণ, রুক্ষতা, ত্বকে অতিরিক্ত তৈলাক্ত ভাব, বয়সের ছাপ ইত্যাদি সমস্যা থেকেও রেহাই পেতে পারেন দইয়ের মাধ্যমে।

#6-ওজন কমাতে দই খাওয়ার উপকারিতা

বর্তমান সময়ে অতিরিক্ত ওজন যেন একটি ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এটার অন্যতম একটি কারণ হলো অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন এবং সচেতনতার অভাব। টেনিস ইউনিভার্সিটির গবেষকদের মতে, নিয়মিত দই খাইলে হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটে। পাশাপাশি, কর্টিজল হরমোনের ক্ষরণ কমে যায়। ফলে ২২ শতাংশ পর্যন্ত ওজন হ্রাসের সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

এছাড়াও, দই একটি কম ফ্যাট যুক্ত স্ন্যাকস জাতীয় খাবার। পাশাপাশি, দইয়ে প্রচুর পরিমাণে আমিষ থাকে যেটা পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে এবং শরীরের শক্তি যোগায়। আর, স্বাভাবিকভাবেই পেট ভরা থাকলে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার ইচ্ছা কমে যায়। তাই অতিরিক্ত ফাস্টফুড না খেয়ে আজ থেকে দই খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন।

#7-ক্যান্সার নিরাময়ে বেশ উপকারী

আমরা আগেই জেনেছি, দই প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ একটি খাবার। এতে উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে যা আপনার পেটকে ভালো এবং স্বাস্থ্যকর রাখে। এটি হজমশক্তি বৃদ্ধি করে, যা চূড়ান্তভাবে প্রদাহ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। পাশাপাশি, প্রোবায়োটিক টিউমার বৃদ্ধি রোধ করতেও সাহায্য করে।

এছাড়াও, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে দইয়ে স্ট্রেপটোকক্কাস থ্রেমোফিলাস ও ল্যাকটোব্যাসিলাস নামের দুটি ব্যাকটেরিয়া থাকে এই ব্যাকটেরিয়া গুলো শরীরে ক্যান্সার কোষের জন্ম এবং বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। অন্য আরো একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দুগ্ধজাতীয় খাবার দই খাওয়ার ফলে মানুষের অন্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি ১৩-১৯ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পায়। 

আবার, আমরা আগেই জেনেছি দইয়ে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম রয়েছে। ক্যালসিয়াম শরীরের বিভিন্ন রকম ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। আর ভিটামিন ডি শরীরের ক্যালসিয়াম শোষণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।

#8-হৃদপিণ্ড ভালো রাখতে সাহায্য করে

মানব শরীরের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হল হৃদপিণ্ড। আর দই হৃৎপিণ্ড ভালো রাখতেও সাহায্য করে। কারণ, দইয়ে ক্যালসিয়াম সহ বিভিন্ন খনিজ উপাদান রয়েছে, যেগুলো উচ্চ রক্তচাপ কমানোর পাশাপাশি হৃদপিন্ডের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে।

তাই পরিবারের যদি কার্ডিওভাস্কুলার রোগের ইতিহাস থাকে তাহলে অবশ্যই দই খাওয়ার অভ্যাস করুন।

#9-উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে

উদ্বেগ বলতে এক ধরনের আবেগকে বুঝায়। যেটা শরীরের অভ্যন্তরীণ অশান্তির একটি বহিঃপ্রকাশ। এটি একটি অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। আর গবেষকদের মতে দইয়ে উপস্থিত উপকারী ব্যাকটেরিয়া গুলো উদ্বেগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।

এছাড়া পাকস্থলীতে উপস্থিত মাইক্রোবায়োম মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত। আর আমরা আগেই জেনেছি পাকস্থলী সুস্থ রাখতে দইয়ের গুরুত্ব অনেক।

এছাড়াও কিছু কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দই খাওয়ার পর আমাদের মস্তিষ্কের ভিতর বেশ কিছু পরিবর্তন শুরু হয়, যেটা মানুষের চাপ ও উদ্বেগ কমাতে ওষুধের মতো কাজ করে। তাই মানসিক সমস্যায় ভুগলে নিয়মিত দই খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন।

সামারি

উপরোক্ত উপকারিতা ছাড়াও দই খাওয়ার আরো অন্যান্য অনেক উপকারিতা রয়েছে। বাচ্চা থেকে শুরু করে বয়স্ক সবার জন্যই উপযোগী খাবার হলো এই দই। তবে যাদের ঠান্ডার সমস্যা আছে তারা রাতের বেলা দই না খেয়ে দিনের বেলা খাইতে পারেন।

কারণ দই খাওয়ার পরপরই শরীরে মিউকাস জমতে শুরু করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সর্দি কাশির প্রকোপ বেড়ে যায়। তাছাড়া দইয়ের নির্দিষ্ট কোন ক্ষতিকর প্রভাব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই আজ থেকেই নিয়মিত দই খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button