এই উপসর্গগুলো ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে

ক্যান্সারের লক্ষণ গুলো কি কি

বিশ্বব্যাপী ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৮ সালে পৃথিবীতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৯৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে বছরে এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ মারা যাবে।

কারণ, ক্যান্সার এমন একটি রোগ যার শুরুর লক্ষণগুলো কিছুটা অস্পষ্ট এবং সাধারণ হয়ে থাকে। পরবর্তীতে এই নিরীহ লক্ষণগুলোই ভয়ংকর ক্যান্সারে রূপ ধারণ করে। এইজন্য ভয় না পেয়ে, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিজেকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করতে হবে।

তাই শারীরিক কোনো অসুস্থতা দেখা দিলে, বিশেষত উদ্বেগজনক কোনো উপসর্গ বোঝা গেলে, অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্দিষ্ট করে ক্যান্সারের লক্ষণগুলো নির্ধারণ করা কিছুটা কঠিন। তারপরও, ক্যান্সারের কিছু কমন লক্ষণ রয়েছে। যেগুলো প্রথম পর্যায়ে দেখা দিলে অবশ্যই সাবধান হতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

চলুন তাহলে ক্যান্সারের বিভিন্ন লক্ষণ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি।

#1-অস্বাভাবিক মাংসপিণ্ড

কোন দুর্ঘটনা ছাড়া আপনি যদি শরীরের কোনো অংশে অস্বাভাবিক কোনো মাংসপিণ্ড দেখতে পান অথবা মাংস জমাট হতে দেখেন আর যদি এই মাংসপিণ্ড ব্যথাবিহীন হয়ে থাকে, তাহলে দেরি না করে দ্রুত পরীক্ষা করান।

কারণ এটি ক্যান্সারের উপসর্গ হতে পারে। এছাড়াও, এই মাংস পিণ্ডটি বড় হতে থাকলে বা স্থান পরিবর্তন করতে থাকলে বা আপনার শরীরে কোনো পরিবর্তন অস্বাভাবিক মনে হলেও পর্যবেক্ষণ করুন‌ এবং চিকিৎসককে জানান।

#2-দীর্ঘদিনের ব্যাথা

বিশেষত কোনো কারণ ছাড়াই (যেমন: জখম, আঘাত ইত্যাদি) আপনার যদি শরীরের কোনো স্থানে দীর্ঘদিন ধরে ব্যথা থাকে, এবং এটা যদি কোন ঔষধেও কাজ না করে, তাহলে এটা নিয়ে ভাবনার কারন আছে।

কারণ, কোন আঘাত ছাড়াই লম্বা সময় ধরে শরীরের কোন অঙ্গে ব্যথার উপস্থিতি ক্যান্সারের লক্ষণ। আবার, অধিকাংশ ব্যথাই ক্যান্সারের লক্ষণ নয়। যেমন, ক্রমাগত মাথাব্যথা হলে এটা ভাবার কারণ নেই যে, রোগীর ব্রেইন ক্যান্সার।

বিভিন্ন কারণে পেটে ব্যথা ও বমি ভাব হতে পারে। তবে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে এই সমস্যা চলতে থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া দরকার। কারণ এই সমস্যাগুলি অগ্নাশয় অথবা লিভার ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

এছাড়াও, ক্রমাগত বুকে ব্যথা ফুসফুসের ক্যান্সার কিংবা তলপেটে ব্যথা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। মোটকথা, শরীরের কোন জায়গায় ব্যথা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে এটা কোন ধরনের ক্যান্সারের লক্ষণ।

#3-দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি

সাধারনত আমরা বিভিন্ন কারণে ক্লান্তি বোধ করে থাকি যেমন: অধিক পরিশ্রম করলে, নির্দিষ্ট পরিমাণ ঘুম না হলে আরো ইত্যাদি কারণে। তাই কোন কারন ছাড়াই আপনি যদি দীর্ঘ সময় ধরে ক্লান্তিবোধ করেন অথবা অবসাদে ভোগেন তবে এটা অনেক রোগেরই লক্ষণ হতে পারে।

পাশাপাশি এটা ক্যান্সারেরও লক্ষণ হতে পারে। মলাশয়ের ক্যান্সার বা রক্তে ক্যান্সার হলে সাধারণত এমন উপসর্গ দেখা যায়। তাই, আপনি যদি স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি ক্লান্তিবোধ করেন অথবা দীর্ঘসময় ধরে ক্লান্ত থাকেন, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

#4-ঘন ঘন জ্বর

বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বর কোন রোগ নয়, এটা যেকোন রোগের উপসর্গকে নির্দেশ করে। 
ক্যান্সারের কোন কোষ শরীরে বিস্তার লাভ করলে শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে ঘন ঘন জ্বর দেখা দেয়। যেমন: লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যানসারের ক্ষেত্রে রক্তে শ্বেত রক্ত কণিকার পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। ফলে জ্বর, সর্দি লেগেই থাকে৷

দুর্ভাগ্যবশত কিছু ক্যান্সারের লাস্ট পর্যায়ে গিয়ে এই উপসর্গ দেখা যায়। তবে ব্ল্যাড ক্যান্সারসহ এ ধরনের কিছু ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়েই ঘন ঘন জ্বর দেখা দেয় শরীরে। তাই এই ধরনের সমস্যা হলে দেরি না করে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

#5-মল-মূত্রত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন

বিভিন্ন কারণে আপনার মল বা মূত্র ত্যাগের অভ্যাসের পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু এটা যদি অস্বাভাবিকভাবে বারবার হয় তাহলে সমস্যা।

কারণ, ঘন ঘন ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য মলাশয়ের ক্যান্সারের লক্ষণ। মূত্রত্যাগের সময় অন্ত্রে ব্যথা বা রক্তক্ষরণ মূত্রথলির ক্যান্সারের উপসর্গ। এছাড়াও, প্রসাবের সময় পেটব্যথা বা প্রসাবের সাথে রক্ত যাওয়া মূত্রথলির ক্যান্সারের লক্ষণ। তাই এই সমস্ত উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

#6-দীর্ঘস্থায়ী কাঁশি

শীতকালীন কাশি বা এলার্জি জনিত কাশি যেটা ঔষধ খেলে দ্রুত নিরাময় হয়, এটা কোন সমস্যা না। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কাশি, যেটা সাধারণ চিকিৎসায় নিরাময় হচ্ছে না এবং এর সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বা গলার স্বর বসে যাওয়া এবং কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়া ফুসফুসের ক্যানসারের অন্যতম লক্ষণ।

আর রোগী যদি ধূমপান করেন, জর্দাসহ পান বা তামাক খান, তবে এটা ক্যানসারের সন্দেহকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়। এই কাশির কারণে আপনার বুক, পিঠ বা কাঁধে ব্যথা করে হতে পারে। এছাড়া, দীর্ঘদিনের কাশি ও ব্রঙ্কাইটিস লিউকোমিয়ার ক্যান্সারের একটি অন্যতম লক্ষণ।

#7-খাবার গ্রহণে সমস্যা

মাঝে মাঝে বদহজম হওয়া বা খিদে কমে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কারণ মাত্রা অতিরিক্ত বেশি খাইলে বা বেশি পরিমাণে ফাস্টফুড খাইলে মাঝে মাঝে এই সমস্যাটা হতে পারে।


তবে, কোন কারণ ছাড়াই একটানা অনেকদিন ধরে ক্ষুধামান্দ্য যদি গ্যাস্ট্রিক,অজীর্ণতা বা আলসারের কারণে না হয় এবং চিকিৎসায় ভালো না হয়, তবে এটা পরিপাকতন্ত্রের ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে।

আবার, কেউ যদি খাবার খেলেই নিয়মিত বদহজমে ভোগেন, তাহলে তার পেট, কণ্ঠনালী বা গলার ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা আছে। সাধারনত আমরা এই সমস্ত সমস্যাকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়ে যায়। তবে আমাদের মনে রাখা উচিত ছোট ছোট রোগগুলো বড় কোন রোগের আভাস দিয়ে যায়।

#8-অকারণে রক্তক্ষরণ

অস্বাভাবিকভাবে শরীর থেকে রক্তক্ষরণ ক্যান্সারের অন্যতম একটি উপসর্গ। যেমন: যদি কাশির সময় রক্তক্ষরণ হয়, তবে এটা ক্যান্সারের বড় লক্ষণ। (অতিরিক্ত কাশি হলে মাঝে মাঝে কাশির সাথে রক্ত আসতে পারে এটা স্বাভাবিক)।

মাসিকের সময় ছাড়া অন্য সময়ে যোনি থেকে রক্তপাত সার্ভিকাল ক্যান্সারের লক্ষণ হতে পারে। আবার, মলদ্বার থেকে রক্তপাতও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে। এছাড়াও, কোন কারন ছাড়াই চোখ এবং ত্বক থেকে রক্তক্ষরণও ক্যান্সারের লক্ষণ।

#9-অকারনে ওজন কমে যাওয়া

কোন ডায়েটিং বা শরীরচর্চা ছাড়াই অস্বাভাবিক হারে শরীরের ওজন কমে যাওয়া কোলন ক্যান্সারের একটি লক্ষণ। 
কারন, ক্যান্সার কোষ প্রায়শই দেহের শক্তি ক্ষয় করে ফেলে। পাশাপাশি খাওয়ার চাহিদাও কমে যায়। এই জন্য দেহের ওজন অস্বাভাবিক হারে কমতে থাকে। আপনার যদি এমনটা হয় তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

#10-অন্যান্য উপসর্গ

উপরোক্ত লক্ষণগুলো ছাড়াও ক্যান্সারের আরো বিভিন্ন লক্ষণ রয়েছে। যেমন: মুখের ভেতরে, মাড়িতে, দাঁতের পেছনে বা জিহ্বার কোনো অংশে দীর্ঘদিনের ঘা মুখের ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণ। ঢোঁক গিলতে কষ্ট হওয়া, খাওয়ার পরে বমি হওয়া বা বমি বমি ভাব হওয়া, অল্প খেলেও পেট ভরে থাকা-অন্ননালি বা পাকস্থলীর ক্যানসারের লক্ষণ।

ত্বকের মধ্যে নানাবিধ পরিবর্তন স্কিন ক্যান্সারের লক্ষণ। যেমন: ত্বক বিবর্ণ হয়ে যাওয়া, কুঁচকে যাওয়া, কালো দাগ পড়া এই সব কিছুই স্কিন ক্যান্সারের লক্ষণ। ত্বকের আঁচিল বা তিলের আকৃতিতে পরিবর্তন স্কিন ক্যান্সারের লক্ষণ (সব আঁচিল বা তিলের সঙ্গে টিউমারের সম্পর্ক নেই)।

তবে কোনো আঁচিল বা তিলের আকৃতি ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়াই ভালো। আবার, ত্বকে ক্রমাগত ক্ষতর কারণে, জিহ্বা, ঠোঁট, পিত্তথলি এবং মূত্রাশয়ের ক্যান্সার সৃষ্টি হয়।

বেশি পরিমাণে ওষুধ ও রাসায়নিক পদার্থ গ্রহণের ফলে পেট এবং লিভারের ক্যান্সার হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে তামাক এবং সিগারেটের খাইলে মুখে এবং ফুসফুসে ক্যান্সার হতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে মদ পান যকৃতের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। পাশাপাশি অন্যান্য অঙ্গ ক্যান্সারও হতে পারে।

অল্প বয়সে যৌন মিলন করা বা একাধিক পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা জরায়ুর মুখের ক্যান্সার সৃষ্টির অন্যতম কারণ। অনেকেরই আবার খাবার গিলতে সমস্যা হয়। এটি মূলত গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল ক্যান্সারের পূর্ব লক্ষণ। তলপেটের দিকে অস্বাভাবিক বা মৃদু ব্যথা প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ।

সামারি

চিকিৎসকরা বলছেন, এইসব উপসর্গের কোনো একটি তিন সপ্তাহ কিম্বা তার চেয়েও বেশি সময় স্থায়ী হলে দেরি না করে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

এছাড়াও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গলা, পাকস্থলি, বাওল, প্যাংক্রিয়াটিক, ওভারি- এই ধরনের অ্যাবডোমিনাল ক্যান্সার এবং ইউরোলজিক্যাল যেসব ক্যান্সার রয়েছে যেমন: প্রোস্টেট, কিডনি এবং ব্লাডার- এসব ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো অনেকটা আড়ালেই থেকে যায়। তাই সব সময় সাবধানে থাকতে হবে এবং উদ্বেগজনক কোন উপসর্গ দেখা দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।

Leave a Comment