কমলা লেবুর খুব গুরুত্বপূর্ণ ১০টি স্বাস্থ্য উপকারিতা
কমলা লেবুর উপকারিতা এবং সাবধানতা
শীতকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ফল কমলালেবু। এই ফল যেমন সুস্বাদু, দেখতে সুন্দর, তেমনই স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। এটি সাইট্রাস সাইনেসিস প্রজাতির একটি সুন্দর আকৃতির ফল। কমলালেবুর বৈজ্ঞানিক নাম “Citrus reticulata“।
চলুন তাহলে কমলা লেবুর স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং সাবধানতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি-
কমলা লেবুর স্বাস্থ্য উপকারিতা
1.রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
একটি কমলাতে প্রায় ১৭০ রকমের ভিন্ন ভিন্ন ফাইটোকেমিক্যাল রয়েছে। এই উপাদানগুলো শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং শরীরকে কর্মক্ষম রাখতেও সাহায্য করে। কমলার এই উপাদানগুলো ধমনীতে চর্বি জমা প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে। পাশাপাশি, কমলাতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন “সি”। আর এই ভিটামিন “সি” শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয় বহু গুণে।
একই সঙ্গে এই ফলটিতে প্রচুর পরিমাণে অ্যাসকর্বিক অ্যাসিড, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং বিটা-ক্যারোটিন এর মত বিভিন্ন উপাদান রয়েছে। এই পুষ্টি উপাদান গুলো সম্মিলিত ভাবে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ছোটবড় বিভিন্ন রোগব্যাধি ও সংক্রমণের হাত থেকে সুরক্ষা করে।
2.হার্টের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করত সাহায্য করে
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন একটি কমলার রস আপনার মারাত্মক স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে। কারণ, কমলা লেবুতে ফাইবার সহ আরও অন্যান্য অনেক উপকারি উপাদান রয়েছে, যেগুলো দেহের ভিতরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর পাশাপাশি রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই হার্ট সুস্থ থাকে এবং হার্টের কোনও ধরনের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা একেবারে কমে যায়।
আবার, কমলায প্রচুর পরিমাণে খনিজ উপাদান রয়েছে, এই উপাদানটি হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি স্পন্দন নিয়মিত রাখতেও সাহায্য করে। ব্রিটিশ জার্নাল অফ নিউট্রিশনে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা প্রতিদিন অন্তত একটি কমলার রস খেয়েছেন, তাদের মস্তিষ্কের রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
3.ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে করে
শীত মানেই ত্বকের আদ্রতা কমে যাওয়া। একই সঙ্গে ত্বকের সৌন্দর্য কমে যাওয়াও যেন খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তাই এই সময় ত্বকের সৈন্দর্য ধরে রাখতে স্কিনের আলাদা করে যত্ন নেওয়াটা একান্ত প্রয়োজন। আর এই কাজে আপনাকে সাহায্য করতে পারে পারে কমলালেবু।
কারণ নিয়মিত এই কমলা লেবুর রস পান করলে শরীরে ভিটামিন সি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মাত্রা তুলনামূলক বাড়তে শুরু করে। ফলে একদিকে যেমন ত্বকের আদ্রতা বজায় থাকে, অন্যদিকে ত্বকের বলিরেখা, কালো ছোপ, কালো দাগ ইত্যাদি কমতে শুরু করে।
আবার, কমলায় থাকা প্রাকৃতিক তেল ত্বকের ময়েশ্চারাইজার হিসাবেও দারুণ কাজ করে। এছাড়াও, ব্রন, সানবার্ন, ত্বকের শুষ্কতা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা থেকে ত্বককে রক্ষা করে একটি সুন্দর ও নমনীয় ত্বক পেতে সাহায্য করে কমলালেবু।
4.ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে
ক্যান্সার রোগ হলো অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন সংক্রান্ত রোগসমূহের সমষ্টি। এখনও পর্যন্ত এই জটিল ও কঠিন রোগের মৃত্যুর হার অনেক বেশি। কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার রোগ খুব সহজে ধরা পড়ে না, ফলে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ভালো কোন চিকিৎসা দেয়াও সম্ভব হয় না।
আর কমলালেবু এই ক্যান্সার রোগ প্রতিরোধ করতে বেশ কার্যকরী। কারণ, একাধিক পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, কমলা লেবুতে উপস্থিত সাইট্রাস লিমোনয়েডস, শরীরে ক্যান্সারের সেল জন্ম এবং বৃদ্ধি আটকাতে সাহায্য করে।
আবার, কমলা লেবুতে “ডি-লিমোনিন” নামক এক ধরণের যৌগ রয়েছে। এই উপাদানটি ত্বকের ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার, এমনকি স্তন ক্যান্সারের মতো রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। এছাড়া, কমলা লেবুতে উপস্থিত ভিটামিন “সি” এবং “অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট” এই দুই উপাদানই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
5.ওজন কমাতে কমলা লেবুর উপকারিতা
শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতে কমলালেবুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। 2014 সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কমলায় থাকা পানি ও ভিটামিন শরীরে চর্বি জমা প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি, শরীরে অতিরিক্ত চর্বি কমানোর প্রক্রিয়াকে আরো শক্তিশালী করে। কমলায় কোন ক্যালোরি নাই, পাশাপাশি এটাতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে।
তাই কমলা খাইলে শরীরে অতিরিক্ত কোন মেদ জমা হয় না, বরং এটা বাড়তি মেদ কমাতে সহায়তা করে। এছাড়াও, মানুষের শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক যেসব পুষ্টি প্রয়োজন যেমন: থিয়ামাইন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি6, ম্যাগনেশিয়াম এবং কপার রয়েছে এই কমলা লেবুতে। তাই ওজন কমাতে আপনিও নিয়মিত কমলা লেবু খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন।
6.ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে
আমরা জানি, ডায়াবেটিস একটি বিপাকজনিত রোগ।আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের মতে, ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যেটা কখনো সম্পূর্ণরূপে সেরে যাবে না। কিন্তু এই রোগকে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
আর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত খাবার গুলোর মধ্যে কমলালেবু অন্যতম। কারণ, কমলাতে উপস্থিত বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুলো রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। পাশাপাশি, এটি ইনসুলিন উৎপাদনেও সহায়তা করে।
এছাড়া, কমলার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই) 40, কিন্তু চিনি ছাড়া কমলার রসের ইনডেক্স (জিআই) ৫০। এই জন্যই বিশেষজ্ঞরা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে বেশি বেশি কমলালেবু খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
7.শরীরের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে
আমরা জানি, কোলেস্টেরল এক ধরনের চর্বি। এই চর্বি কয়েক ধরনের হয়ে থাকে যেমন: ট্রাইগ্লিসারাইড, এলডিএল, এইচডিএল এবং টোটাল কোলেস্টরল। এর মধ্যে একটা হলো উপকারী। আর তিনটি আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আর শরীর থেকে এই ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমাতে কমলালেবুর ভূমিকা অনেক।
কমলাতে দ্রবণীয় ফাইবার থাকে। যাকে বলা হয় পেকটিন। এটি রক্ত স্রোতে শোষিত হওয়ার আগে শরীর থেকে কোলেস্টেরল দূর করে। পাশাপাশি, এটি খারাপ কোলেস্টেরল হ্রাস করে এবং ভাল কোলেস্টেরল বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
২০১০ সালে জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্রে দেখা গেছে, উচ্চ এলডিএল (খারাপ কোলেস্টোরেল) কোলেস্টেরল যুক্ত একটি লোককে 60 দিন নিয়মিত কমলার রস খাওয়ানোর পর তার খারাপ কোলেস্টেরল কমে গেছে। এছাড়া, কমলার মধ্যে থাকা ফাইবার কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করতে সহায়তা করে।
8.চোখের দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে
দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখতে আপনার প্রতিদিনের খাবার তালিকায় কমলালেবু যোগ করতে পারেন। কারণ, কমলা লেবু ক্যারোটিনয়েডের একটি অন্যতম ভালো উৎস। এছাড়া, আমরা আগেই জেনেছি কমলাতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে, যেটা চোখের শ্লেষ্মা ঝিল্লি স্বাস্থ্যকর রাখতে খুবই কার্যকরী।
আবার এই ভিটামিন ‘এ’ বয়স সম্পর্কিত ভাস্কুলার প্যাথলজি প্রতিরোধ করতেও খুবই কার্যকর। যেটা বেশী হলে যেকোনো ব্যক্তি অন্ধ হয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি, এটি চোখকে আলো শোষণ করতে এবং রাতের দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতেও সহায়তা করে।
9.কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
মলত্যাগ যদি সপ্তাহে তিনবারের কম হয়, অথবা অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও মলত্যাগ না হয়, অথবা মল স্বাভাবিকের থেকে বেশি শক্ত বা শুকনো হয়, অথবা পরিমাণে খুব কম হয়, তাহলে তাকে কোষ্ঠকাঠিন্য বলে। আর এই কোষ্ঠকাঠিন্যের পিছনে অস্বাস্থ্যকর খাদ্য অভ্যাস এবং জীবন যাপনই সবথেকে বেশি দায়ী।
তাই কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে প্রতিদিন খাদ্য তালিকায় কমলালেবু রাখতে পারেন। কারণ, কমলা লেবুতে দ্রবণীয় এবং অদ্রবণীয় উভয়ই ধরনের ফাইবার রয়েছে। ফলে, এটি একজন মানুষের অন্ত্র এবং পেটের কার্যকারিতা মসৃণ রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া, এই ফলটিতে খুব বেশি ক্যালরি নেই। একটা মাঝারি আকারের কমলায় ৬২ ক্যালরির মতো শক্তি পাওয়া যায়, কিন্তু এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে।
10.কমলা লেবুর অন্যান্য উপকারিতা
উপরোক্ত উপকারিতা গুলো ছাড়াও কমলা লেবুর আরো অন্যান্য অনেক উপকারিতা রয়েছে। যেমন-
- মাড়ির ব্যথা, দাঁতের সমস্যা, মুখের দুর্গন্ধ ইত্যাদি সমস্যা সমাধানে বেশ কার্যকরী।
- কমলা শরীরে ওষুধ গ্রহণের ক্ষমতা বা ওষুধের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি, এই ফলের রস ওষুধের বায়োকেমিক্যাল ও সাইকলজিকাল প্রভাব শরীর গ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত বিভিন্ন রোগ থেকে সুস্থ হতে সাহায্য করে।
- এছাড়া, কমলালেবুতে ভিটামিন বি৬ রয়েছে, এই ভিটামিনটি রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সহায়তা করে।
- কমলালেবুর রস শরীরের ফ্লেবোনয়েড এবং বেশ কিছু নিউরোট্রান্সমিটারকে অ্যাকটিভ করে দেয়। ফলে অনিদ্রার সমস্যা দূর হয়,
পাশাপাশি স্মৃতিশক্তি এবং কগনিটিভ পাওয়ার বাড়াতে সাহায্য করে। এছাড়া, মুত্রনালীর ক্ষত সারাতেও কমলা লেবুর রসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
সাবধানতা
কমলালেবুর উপকারিতা সম্পর্কে আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি। তবে এটা খাওয়ার সময় অবশ্যই আমাদের কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন:
- কমলা লেবু অতিরক্তি পরিমাণে খাইলে বদহজম, ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, গলা-বুক জ্বলা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- গর্ভবতী এবং দুগ্ধ দানকারী মায়েদের জন্য কমলা বেশ উপকারী, তবে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ খেতে হবে। অতিরিক্ত পরিমাণে খাইলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- যাদের হার্টের সমস্যা রয়েছে তাদের কমলা লেবু বেশি না খাওয়াই ভালো। কিডনির সমস্যার জন্য যাঁদের হাই পটাশিয়াম যুক্ত খাবারের উপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাদের কমলালেবু খাওয়ার আগে অবশ্যই একজন পুষ্টিবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া উচিত।
- ছোট বাচ্চাদের বেশি কমলা লেবু দেওয়া উচিত নয়। কারণ এটি পেটে ব্যথা এবং সিনকোপের মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে। আবার, যারা বিটা ব্লকারগুলি সেবন করেন, তাদের মাত্রা অতিরিক্ত কমলা খাওয়া উচিত নয়।
- অতিরিক্ত লেবু খাইলে পাকস্থলীতে অ্যাসিডিটির সম্ভাবনা বেড়ে যায়, পাশাপাশি বারবার পাতলা পায়খানা সহ শরীর শুকিয়ে যাওয়ার মতো বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।
এছাড়াও, অতিরিক্ত কমলালেবু খেলে মুখের মধ্যে থাকা নরম কোষ গুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে, মুখের মধ্যে বিভিন্ন রকম ফোড়া বা ফুসকুড়ি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তাই কমলালেবু খাওয়ার সময় অবশ্যই সাবধানতা অবলম্বন করুন।
উপসংহার
কমলা বা কমলালেবুর রস অত্যন্ত পুষ্টিকর একটি খাবার। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন রোগের পথ্য হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। একজন মানুষের শরীরের জন্য একদিনে যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন হয়, তার প্রায় পুরোটাই একটি কমলা লেবুতে পাওয়া যায়।
মানবদেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বা মজবুত করতে খুবই কার্যকরী এই ফল। ভিটামিন-‘সি’ সমৃদ্ধ এই ফল বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রমণ রোধ করতে দারুণ কার্যকরী। তাই নিয়মিত কমলা খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন।